স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
যশোরের অজপাড়াগাঁয়ের গৃহিনি রুপা খাতুন কাঁঠালের চিপস তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন। স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তার ঘরোয়া পরিবেশে তৈরি এই কাঁঠালের চিপস বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কাঁঠালের চিপস তৈরি করে তিনি নিজে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে সাথে সাথে গ্রামের অন্য মহিলাদের কর্মসংস্থান তৈরি করছেন।
কাঁঠালের চিপস তৈরি করে মাসে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন যশোরের রূপা খাতুন। এক সময় যারা নাক সিটকে সমালোচনা করতেন; এখন তারাই রূপা খাতুনের কাজ দেখতে আসেন। আসেন পরামর্শ নিতে।
যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের ইখতার আলীর স্ত্রী রূপা খাতুন এখন কাঁঠালের চিপস তৈরির কারিগর হিসাবে পরিচিত। অজপাড়াগাঁয়ের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ‘রেইনবো এগ্রো ফুড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অনেক দিন ধরেই তিনি বাড়িতে নানা রকমের আচার, জ্যাম-জেলি, কুমড়োর বড়ি, গুড়-পাটালিসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছেন। এ বছরই তিনি শুরু করেছেন, কাঁঠালের চিপস তৈরি। কাঁঠালের চিপসে বাজিমাত করা রূপা খাতুনের এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার নিষ্ঠা-একাগ্রতা।
রূপা খাতুনের বাবার বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার পুশখালি গ্রামে। বাবা শামসুর রহমান বিশ্বাস কাঠের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৬ সালে রূপা খাতুন ৭ম শ্রেণি থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ৮ম শ্রেণিতে ওঠেন। এ সময় হঠাৎ করেই বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। সাত ভাইবোনের সংসারে কিছু টানাপোড়েন আর ভালো ছেলে পাওয়ার সুবাদে বিয়ে হয়ে যায় তার। চলে আসেন স্বামীর বাড়ি যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বই খাতার ভাঁজে ফেলে রেখে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। এরই মধ্যে একে একে তিন সন্তানের মা হয়ে যান। স্বামী কাপড়ের ব্যবসায়ী ও টেইলার্স মাস্টার হওয়ায় এক সময় তিনিও সেলাইয়ের কাজ শেখেন। যদিও সেলাইয়ের কাজ তাকে খুব বেশি টানতে পারেনি। শ্বশুর ক্যান্সারে অক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর রুপা খাতুনের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। এরপর নিজের প্রচেষ্টায় আগ্রহের জায়গাটি খুঁজে পান রূপা খাতুন। ২০১৯ সালের দিকে তিনি খাদ্যপণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
বিভিন্ন মৌসুমি ফল সিজনের কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় যেমন এর দাম পাওয়া যায় না; তেমনি বড় একটি অংশ অপচয়ও হয়। এ ভাবনা থেকে বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি শুরু করেন রুপা খাতুন। তিনি উন্নয়ন সংস্থা ‘সুশীলন’ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের পর আম-তেঁতুলের আচার, সস, জ্যাম-জেলি,কাঁঠালের আচার ইত্যাদি তৈরি শুরু করেন। এরই মধ্যে তিনি তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় অন দ্যা জব প্রশিক্ষণের খবর পান। ‘প্রিজম এগ্রো অ্যান্ড ফুড’ থেকে এ প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন কাঁঠালের চিপস তৈরি। কাঁঠালের চিপসের কথা শুনে প্রথম দিকে সবাই হাসত, নাক সিটকাত। কিন্তু এখন এ চিপস বেশ সাড়া ফেলছে।
চিপস তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রথমে কাঁঠাল কেটে কোষগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে আঁটি বের করে ফেলতে হয়। এরপর কাঁঠাল চিপসের আকারে কেটে তেলে ভাজতে হয়। পরে মসলা মিশিয়ে প্যাকেট করতে হয়। প্রতি প্যাকেট দোকানে খুচরা ২০ টাকা করে বিক্রি হয়। এভাবে প্রতি দিন গড়ে তিনশ’ প্যাকেট চিপস তৈরি করেন রূপা। খরচ বাদে গড়ে প্রতি মাসে এই চিপস থেকেই তার ২০ হাজার টাকা উপার্জন হচ্ছে।
রূপা খাতুন হাতে ভাজলেও এ প্রক্রিয়াটি মেশিনে করাও সম্ভব। সেজন্য তার ভ্যাকুয়াম প্রাইম, ডি অয়েলিং এবং প্যাকেজিং মেশিন দরকার। এ ছাড়া কাঁঠালের কোষ কেটে প্রসেসিং করে ফ্রিজে রেখে আরও তিন মাস এ চিপস উৎপাদন ও বাজারজাত করা সম্ভব। এই কাজের মাধ্যমে একদিকে যমেন নিজ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করছেন তেমনি প্রতিবেশিদের তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থান। গ্রামের অনেক মহিলা তার সাথে কাঁঠালের চিপস তৈরির কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন।
পরিবারের সদস্যরা তাকে এই কাজে সব সময় সহযোগিতা করছেন। এছাড়া পুষ্টিকর এই চিপস খেতে পেরে খুশি শিশুরাও।
উদ্যোক্তা রুপা খাতুন জানান, কাঁঠাল বাচ্চা থেকে শুরু করে বড়রা কেউ খেতে চাই না। বিকল্প ভাবে খাওয়ার জন্য চিপস তৈরি করার উদ্যোগ নেন তিনি। এক সময় এলাকার মানুষ তার এই কাজের সমালোচনা করত। কিন্তু বর্তমানে তিনি তার স্বামীর সাথে পরিবারের ব্যয় বহন করতে সক্ষম হচ্ছেন। এই কাজের মাধ্যমে স্থানীয় মহিলাদেরও কর্মস্থান তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই কাজে তিনি পরিবারের পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা পাচ্ছেন।