আবু জাফর, চৌগাছা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘কোনকালে একা হয়নি ক একা জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।’

এক সময় নারীদের অবহেলার চোখে দেখা হলেও, এখন তারা আর অবহেলিত নয়, বরং তাদের মেধা, দক্ষতা ও শ্রমের মাধ্যমে তারা সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। যুগে যুগে বেগম রোকেয়ার দেখানো পথ ধরে নারীরা আজ আলোর পথে এগিয়ে চলেছে।

নারীর অগ্রগতির এই ধারা দেশের সকল ক্ষেত্রে আজ সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এই ধারাবাহিকতায় চৌগাছা উপজেলার প্রশাসনেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এক ঝাঁক উদীয়মান, দক্ষ ও আত্মপ্রত্যয়ী নারী।

তাদের কর্মস্পৃহা, দায়িত্ববোধ ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছেন। ফলে তারা নারী সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। চৌগাছার প্রশাসনিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলা বিষয়ক, প্রকৌশল, আনসার ভিডিপি, প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তারা নেতৃত্ব দিয়ে প্রমাণ করছেন যে, নারীরা শুধু রান্না বা বাড়ির মধ্যে বন্দীর মতো জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত নন। তারা সমাজে যোগ্য স্থানে নিজেদের জায়গা করে নিয়েই প্রগতির পথে অগ্রগামী।

♦ফারজানা ইসলাম (ইউএনও)
ফারজানা ইসলাম শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্যানতত্ত্ব বিষয়ে অনার্সসহ মাস্টার্সে মেধাক্রমে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ৩৬তম বিসিএস-এ (প্রশাসন) ২০১৮ সালে তিনি ক্যাডার হয়ে যশোরে এসিল্যান্ড পদে যোগদান করেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি ২০২৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। জুলাই ২০২৪ পরবর্তী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তিনি নজির স্থাপন করেছেন। নেতাদের মনোভাব, চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষেই তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রশাসন চালাচ্ছেন। রাজনীতিবিদরাও তার প্রতি খুশি। তিনি প্রশাসনিক সকল কাজসহ হয়ে যাওয়া এসএসসি, এইচএসসি, ডিগ্রি ও অনার্স পরীক্ষা নকল মুক্ত সুন্দর পরিবেশে নেওয়ার নজির দেখিয়েছেন।

বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে সব সময় জিরো টলারেন্স দেখান তিনি। এসব ক্ষেত্রে কারো অযাচিত চাওয়া-পাওয়ায় তিনি মাথা নত করেননি। তিনি একজন দুর্নীতিমুক্ত, উদার মনের ও স্বচ্ছ প্রশাসক হিসেবে সহকর্মীদের কাছে পরিচিত। তিনি বর্তমান মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন।

♦তাসমিন জাহান (এসিল্যাণ্ড)
সদা হাস্যোজ্জ্বল তাসমিন জাহান উপজেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ইউএনও মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকায় তাকে সহকারী ভূমির দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত ইউএনও, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌর প্রশাসকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

তাসমিন জাহান খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি সিভিল উত্তীর্ণ হওয়ার পর ৩৮তম বিসিএস-এ ক্যাডার হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। ৯ অক্টোবর ২০২৫ তিনি চৌগাছা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর রাজনৈতিক নেতাদের দখলে থাকা একের পর এক খাস জমি দখলমুক্ত করা, দ্রুতগতিতে ভুক্তভোগীদের নামজারি, সংশোধন, ভোক্তা অধিকার আইনে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে সুনাম কুড়িয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি বিগত সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের দখলে থাকা ২০ একর সরকারি জমি উদ্ধার করেছেন। সরকারের ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, রেকর্ড হালকরণ, খাস জমি, অর্পিত জমি, হুকুম দখল, সায়রাত মহাল ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কাজে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।

ইউনিয়ন ভূমি অফিসসহ তার অফিসকে তিনি ঘুষমুক্ত ঘোষণা করেছেন। চারটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপালে অসুবিধা হচ্ছে কিনা, জবাবে তিনি বলেন, অর্পিত দায়িত্ব পালনতো করতেই হবে, তবে সময় ম্যানেজ করাটা একটু কঠিন।

♦তাসলিমা জেবিন (মৎস্য কর্মকর্তা)
তাসলিমা জেবিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিশারিজ-এ বিএসসি অনার্স করে ৪৩তম বিসিএস-এর মাধ্যমে মৎস্য ক্যাডারের আওতায় তিনি ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে প্রথম উপজেলা চৌগাছাতে মৎস্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। যোগদান করার পর থেকে তিনি উপজেলায় নারীদের মৎস্য চাষে আগ্রহী করে তুলতে তাদের কারিগরি সহায়তা প্রদানসহ প্রশিক্ষণে সচেষ্ট রয়েছেন। তার প্রচেষ্টায় উপজেলার অনেক নারী-পুরুষ মৎস্য চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

♦সামসুন নাহার (পিআইও)
ফরিদপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে লেখাপড়া শেষ করার পর ২০১৮ সালে প্রথম যশোর বাঘারপাড়া উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ২২ অক্টোবর ২০২৩ সালে তিনি চৌগাছা উপজেলায় যোগদান করার পর থেকে দক্ষতার সাথে ভিজিএফ-এর আওতায় অসহায় ও দুস্থদের মধ্যে খাদ্য শস্য বিতরণ, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাসহ গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন বলে জানান।

♦আনজুমান আরা মাহমুদা (মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণীবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্সসহ এমএসসি পাশ করার পর তিনি ১৯৯৭ সালে প্রোগ্রামার হিসেবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে যোগদান করেন। ৫ জুলাই ২০২৩ সালে চৌগাছাতে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করার পর তিনি একের পর এক চমক লাগিয়ে চলেছেন। দুস্থ ও অসহায় মহিলাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য, বিচ্ছেদ কিংবা বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সমাধানে সচেষ্ট থাকেন। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের দুই হাজার আটশত ছাব্বিশটি ভিজিডি কার্ডের সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের মাঝে মালামাল বিতরণের দায়িত্ব নেয়ার পর অনেক চিত্র পাল্টে গেছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের চাওয়া-পাওয়ায় সমঝোতা না করায় অনেকে তার ওপর ক্ষুব্ধ। তিনি নারীদের উন্নয়ন, আত্মকর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

♦ফেরদৌসী খাতুন (সহকারী প্রকৌশলী)
উপজেলায় জনস্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছেন সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌসী খাতুন। তিনি যশোর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা-ইন-সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে ১৯৯৪ সালে এ পেশায় যোগদান করেন। ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানপূর্বক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কীভাবে স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়, সেই লক্ষ্যে তিনি গ্রামের মানুষকে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছেন।

♦রিজিয়া খাতুন (আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা)
রিজিয়া খাতুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে অনার্স সম্পন্ন করে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগদান করেন। তিনি ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ সালে চৌগাছা উপজেলা আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করার পর ট্রেনিং-এর মাধ্যমে আনসারদের আত্মমর্যাদাবান বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। গ্রাম বাংলার আর্ত-মানবতার সেবাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি দেশ সেবায় নিজেকে সৈনিক হিসেবে আনসার ভিডিপি-তে যোগদান করতে পেরে গর্ববোধ করেন।

♦নাসরিন সুলতানা (একাডেমিক সুপারভাইজার)
নাসরীন সুলতানা উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি অনার্স ও এমএসসি (এমএড) সম্পন্ন করার পর ২০০৭ সালে প্রথম একাডেমিক সুপারভাইজার পদে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চৌগাছা উপজেলায় যোগদান করার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ কলেজের (আংশিক) একাডেমিক সকল কাজ দক্ষতার সাথে সুপারভিশন করে যাচ্ছেন। তিনি যোগদান করার পর থেকে ইউএনও-এর প্রতিনিধি হিসেবে প্রতি বছর এসএসসি, এইচএসসি, দাখিল ও আলিম পরীক্ষার সকল প্রশ্নপত্র ডিসি অফিসের ট্রেজারি থেকে থানায় আনা থেকে শুরু করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিটি কেন্দ্রের প্রশ্নপত্র সর্টিং সম্পন্ন করেন। উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজের কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর উপবৃত্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলো তিনি দেখভাল করেন।

♦মুমতাহীনা বিলকিস (এটিও)
সদা হাস্যোজ্জ্বল মুমতাহীনা বিলকিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ মাস্টার্স শেষ করে ২০১৪ সালে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি ২১ আগস্ট চৌগাছা উপজেলায় সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং উপজেলার সদর ক্লাস্টারের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেয়ার পর পরই তিনি একের পর এক ক্লাস্টারের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ভিজিট অব্যাহত রেখেছেন। ভিজিটের কারণে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা একটু বাকা নজরে দেখলেও ইতোমধ্যে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করেছেন তিনি।

Share.
Leave A Reply

Home
News
Notification
Search
Exit mobile version