হাসান আদিত্য
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তিন বছরের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলো সাড়ে চার বছর পর। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তরুণ ও সাবেক ছাত্রনেতা জায়গা করে নিলেও বাদ পড়েছেন উপজেলার অনেক ত্যাগি নেতা ও বিগত কমিটির কেউ কেউ। সাধারণ সম্পাদক হাসান আলীর ছেলে ও দুই স্ত্রীর তিন ভাই কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। দলীয় নেতাকর্মী হত্যা মামলার এমন আসামিও স্থান পেয়েছেন কমিটিতে। কমিটি গঠনে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়রও। এছাড়া পদ পেয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বিএনপি থেকে যোগ দেয়া ব্যক্তিরাও। এদিকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। দুর্দিনের নেতাকর্মীরা তাদের কাক্সিক্ষত পদ না পাওয়ায় দলের মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। ইতোমধ্যে অন্তত ১০ জন নেতা এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার উপজেলায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মী ও কাক্সিক্ষত পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা।
জানা গেছে, দীর্ঘ ১৫ বছর পর ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সাবেক সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়কে পুনরায় সভাপতি ও আগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে আংশিক কমিটি ঘোষিত হয়। সে সময় নবনির্বাচিত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে ১৫ দিন সময় বেঁধে দেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। কিন্তু সে নির্দেশনা মানেননি কেউই। জেলা কমিটি বারবার তাগিদ দিলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে ব্যর্থ হন সভাপতি-সম্পাদক। এর পর ২০২২ সালের ৩১ জুলাই রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন স্বাক্ষরিত বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হয়। যেখানে স্বাক্ষর ছিল না জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে নানা বিতর্ক। এর দুইদিন পর ২ আগস্ট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের ধানমন্ডির অফিসে আহুত এক জরুরি সভায় কথিত ওই কমিটি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে শুধু সভাপতি ও সম্পাদক-এই দুইজনের ওপর ভর করেই চলছিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। সংসদ ও উপজেলা বা স্থানীয় কোন নির্বাচনে এক হননি দুই নেতা। বেশির ভাগ সমাবেশেও এক মঞ্চে দেখা যায়নি তাদের। বিভক্ত দ্বদ্বে মেয়াদউত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটিয়েছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে সম্মেলনের সাড়ে চার বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে রনজিত রায়কে সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া উপদেষ্টা রাখা হয়েছে ২১ জনকে। জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় প্যাডে স্বাক্ষর করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তাতে কোন তারিখ লেখা হয়নি। ফলে কমিটির তালিকা নিয়ে একদিকে যেমন বির্তক সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে পদ পাওয়া না পাওয়া নেতাকর্মীদের মধ্যেও হতাশা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, টাকার বিনিময়ে উপজেলা ও জেলার নেতাকর্মীরা পদ বিক্রি করেছেন। যে যত টাকা দিয়েছে, সে তত সম্মানজনক পদ পেয়েছেন।
পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যারা আছেন তারা হলেন- সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হোসেন বিশ্বাস, কবীর খান (জামান), অধ্যক্ষ আজগর আলী, লোকমান হেকিম, হরিপদ রায়, প্রভাষক করসার হোসেন, মারুফ হোসেন, সহকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ভিক্টোরিয়া পারভীন সাথী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পি এম রেজাউল ইসলাম (দিলু পাটোয়ারি), আব্দুর রউফ মোল্ল্যা, রাসেল পারভেজ, আইন বিষয়ক সম্পাদক গোলাম নবী, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক এনামুল কবীর লিটন, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ইদ্রিস আলী, দপ্তর সম্পাদক মনিরুজ্জামান তরুণ, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম, প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মুকুল রেজা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জাকির হোসেন। মহিলা বিষয়ক সম্পাদক জাকিয়া সুলতানা, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক একিন উদ্দিন, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রিয়াদ হোসেন, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান টিটো, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মুন্সি বাহার উদ্দিন, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডা. নিকুঞ্জ বিহার গোলদার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুজ্জামান ভোলা, শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ইফনুস আলী শেখ। সহ দপ্তর সম্পাদক নজরুর ইসলাম, সহ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোশারফ হোসেন, কোষাধাক্ষ বাবলু কুমার সাহা। এছাড়া সভাপতি রনজিত রায়ের ছেলে রাজীব রায়, পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান বাচ্চুসহ ৩৫ জনকে সদস্য রাখা হয়েছে। এছাড়া উপদেষ্টা রাখা হয়েছে ২১ জনকে।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ছেলে এনামুল কবীর লিটনকে দেয়া হয়েছে কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক। সেক্রেটারির দুই স্ত্রী। দুই পক্ষের দুই শ্যালক মারুফ হোসেনকে সহসভাপতি ও শ্যালক মনিরুজ্জামান তরুণকে দেয়া হয়েছে দপ্তর সম্পাদকের পদ। অপর শ্যালক কবীর খান জামান ২ নং সহসভাপতির পদ পেয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ এ কমিটি গঠনে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়র। সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক করা হয়েছে জহুরপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাচনের নৌকা প্রতীকের এজেন্ট ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী টুটুল হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি আসামি দিলু পাটোয়ারিকে। ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন দিলু পাটোয়ারি। রাজনীতিতে দিলুর চেয়ে অনেক সিনিয়র উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ মোল্যাকে দেয়া হয়েছে ২ নং যুগ্ম সম্পাদকের পদ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আব্দুর রউফ বলেন, ‘কমিটিতে বৈষম্য অনেক। যারা বিএনপির রাজনীতি করে, যাদের আন্দোলন দলীয় কর্মসূচিতে থাকে না এমন ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে। কমিটিতে ত্যাগিদের মূল্যায়ন করা হয়নি। কমিটিতে সেক্রেটারির আত্মীয় স্বজন পরিবারের এমন আট সদস্য স্থান পেয়েছে। সভাপতির নিকট সহচর ও স্বজনদের রেখেছেন। মূলত উপজেলাতে সভাপতি-সম্পাদক পৃথক বলয় সৃষ্টি করতে তাদের লোকজন দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেছেন। তিনি বলেন, দলের এখন ক্রান্তিকাল তা নাহলে আমরা অনেকেই পদত্যাগ করতাম। কিন্তু সেটি এখন না করে, কেন্ত্রীয় নেতাদের কাছে যাবো। সংবাদ সম্মেলন করবো।’
এছাড়া উপজেলা সম্পাদক হাসান আলীর শ্যালক মনিরুজ্জামান তরুণকে দপ্তর সম্পাদকের পদ দিয়ে সহদপ্তর সম্পাদক করা হয়েছে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র নেতা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুর্দিনের নেতা নজরুল ইসলামকে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ বলেন, ‘অনেক ত্যাগী নেতা যারা আন্দোলন করেছে রাজপথে। দলের জন্য জীবনটা নষ্ট করেছে তারা দলে জায়গা হয়নি। অথচ সভাপতি-সম্পাদকরে আত্মীয় স্বজন, বিএনপির রাজনীতি থেকে আসা নেতাকর্মীদের জায়গা হয়েছে। কমিটিতে সিনিয়র জুনিয়র মানা হয়নি। যে যত টাকা দিয়েছে, তার পদ বড় হয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা অনেকেই সিন্ধান্ত নিয়েছি পদত্যাগ করবো।’
আগে কখনো আওয়ামী লীগ করেননি, কিংবা বাঘারপাড়ার রাজনীতিতে কখনো দেখা মেলেনি; এমন ব্যক্তিকে সহসভাপতিসহ সম্পাদকীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়েছে। আগের কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে ৮ নম্বর সহ-সভাপতি র পদ। তিনিও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কমিটিতে লন্ডন প্রবাসী মেহেদী হাসান টিটোকে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদকের পদ। পদ দেয়া হয়নি অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ কুমার অধিকারীসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতাকে। অথচ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন এক সময়ের বিএনপির তুখোড় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সহিদুল্লাহ। খন্দকার সহিদুল্লাহর আপন ভাই খন্দকার আসাদুজ্জামান ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি ও আপন ভাতিজা খন্দকার মেহেদী হাসান পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। রাজনীতিতে সক্রিয় উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল হুসাইন নান্নু এই কমিটিতে স্থান পাননি। নাজমুল নাজমুল হুসাইন নান্নু বলেন, ‘ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে যাদের নেতা বানিয়েছি- তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। অথচ আমি পাইনি। আমি টাকা দিতে পারিনি, তাই হয়তো নাম রাখেননি কমিটিতে। এখন থেকে আর দলীয় প্রোগ্রামে উপস্থিত হব না’।
নাম না প্রকাশে এক সহ-সভাপতি বলেন, ‘সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায় তার পছন্দের নেতাদের কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বর্তমানে বাঘারপাড়ার রাজনীতিতে কোণঠাসা রনজিৎ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে আধিপত্য বিস্তার করে রাজনীতির মাঠে ফেরার চেষ্টা করার জন্য আত্মীয় স্বজন ও ছেলেকে বসিয়েছেন তিনি।’
এই বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রনজিত রায় বলেন,‘উপজেলা ও জেলার সভাপতি সম্পাদক একসাথে হয়ে কমিটি করেছি। কমিটি অনেক সুন্দর হয়েছে। বাদ পড়লে অনেকে অভিযোগ করে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।’
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘কমিটি করার ইচ্ছা ছিলো অনেক আগে। এখন সময় পেয়েছি করেছি। দল ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকাতে অনেক নেতা হয়েছে। সবাই তো কমিটিতে স্থান পাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যারা সভাপতি-সম্পাদকের আত্মীয় স্বজন নিয়ে অভিযোগ করছেন তারা সবাই ত্যাগী নেতা। হত্যা মামলার আসামি যাকে বলা হচ্ছে, উনি ত্যাগি নেতা। প্রবাসী একজনও কমিটিতে স্থান পেয়েছে প্রসঙ্গে বলেন, উপজেলার সভাপতি-সম্পাদক আমাদের কমিটির কাগজ এনেছে, আমরা স্বাক্ষর করেছি। বিএনপি নেতাকর্মী, বিদেশে রয়েছে এমন লোক থাকলে আমরা বিষয়টি দেখছি।’