♦অন্য সময়ের চেয়ে যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো : যশোর পুলিশের মুখপাত্র বেলাল হোসাইন
♦নানা ধরনের সোর্স ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিবি পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে : ডিবি ওসি রুপণ কুমার সরকার
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠেছে প্রাচীন জেলা যশোর। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে শংকায় আছেন সাধারণ জেলাবাসী। পুলিশি ব্যাপক তৎপরতার মাঝেও অপরাধী চক্র লাগামহীন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যেন কোন এক অদৃশ্য সূতোর টানে। এর ফলে ঘটে চলেছে একের পর এক খুন-জখম, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে যশোরে অন্তত ডজন খানেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সর্বশেষ ২৭ ফেব্রয়ারি রাতে শহরের শংকরপুরে আকাশ সরদার (২৩) নামে এক ওয়লেডিং মিস্ত্রিকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত আকাশ সরদার যশোর শহরের শংকরপুর বটতলা এলাকার তোতা সরদারের ছেলে। গোল্ডেন সাব্বির, অনিক, সোহেল, ছোট আকাশসহ কয়েকজন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নিহতের পরিবারের দাবি।
নিহতের ভগ্নিপতি আনিসুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, আকাশ সরদার ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১২টার দিকে সন্ত্রাসী গোল্ডেন সাব্বির তাকে মোবাইলে ডেকে নিয়ে যায়। শংকরপুর বটতলায় আসলে পূর্বশত্রুতার জের ধরে আকাশের বাম পাশের গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। গোল্ডেন সাব্বিরের সাথে ছিলো সোহেল, অনিক, সিরাজুল ও ছোট আকাশ। খবর পেয়ে গুরুতর রক্তাক্ত অবস্থায় আকাশকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার শফিকুর রহমান বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। আকাশের গলার বাম পাশে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, চোরাই সোনা ও ছিনতাইকৃত টাকার ভাগাভাগি এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা আকাশকে খুন করে।
এর আগে শনিবার ২৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে দুই পাড়ার দ্বন্দ্বে খুন হয় স্কুল ছাত্র চয়ন। সূত্র জানায়, ২১ ফেব্রুয়ারি জমি জায়গা নিয়ে বিরোধে খুন হয় রূপদিয়ার কাজী নাইমুর রহমান হিমেল। তার আগের দিন ২০ ফেব্রুয়ারি শংকরপুরের রিক্সাচালক বাদশা মোল্যার লাশ উদ্ধার হয় বাহাদুরপুর এলাকা থেকে। রিক্সা চালাতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে মাদক ব্যবসায়ি চক্রের ছুরিকাঘাতে খুন হয় বারান্দীপাড়ার টগর নামে এক যুবক। ১৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার শার্শার পাকশিয়া থেকে লাশ উদ্ধার হয় এনামুল হক নামে এক ব্যক্তির। আগের দিন ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় খুন হয় যুবলীগ নেতা মুরাদ হোসেন।
এর আগে, ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে সদরের রামনগরে চোর অপবাদ দিয়ে এক ভাটা শ্রমিককে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক ও পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ঘটনার আগের দিন ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা রাতে যশোর রেলস্টেশনে কুখ্যাত সন্ত্রাসী রনি-প্রিন্সের নেতৃত্বে একদল মাদক কারবারি কুপিয়ে খুন করে জুম্মান নামে এক যুবককে। যার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় ৬ মাদক কারবারি জুম্মানকে ধাওয়া করছে। একপর্যায়ে তাদের ছুড়ে দেয়া চাকু জুম্মানের পায়ে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে চক্রটি এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে যশোরে অন্তত এক ডজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এসব খুনোখুনির ঘটনার মূলে রয়েছে পক্ষ-বিপক্ষের দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র বেচা-বিক্রিসহ নানা কারণ। খুনোখুনির পাশাপাশি চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা লেগেই আছে। প্রকাশ্যে এসব খুনের ঘটনা ঘটলেও মূল আসামি ও গডফাদাররা ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনায় জড়িতদের ডিবি পুলিশ আটক করে।
৯ ফেব্রুয়ারি সকালে শহরতলির বালিয়াডাঙ্গা মানদিয়া জামে মসজিদের পেছন থেকে আগুনে পোড়া এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অর্ধপোড়া লাশ উদ্ধারের পর পুলিশের ধারণা ছিলো পেট্রোল ঢেলে মুখমন্ডলসহ সারাদেহ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্ট করেছে খুনি। পরে পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় যশোর ডিবির ওসি রূপণ কুমার সরকারের নেতৃত্বে একটি চৌকস দল সিসিটিভি ফুটেজ দেখে খুনিকে সনাক্ত ও তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে খয়েরতলা থেকে মেহেদী হাসান লিখন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। পরে সে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জানায় নিহত মহসীন মন্ডল তার কাছে সুদে টাকা পেতেন। এই টাকার জন্য গালি-গালাজ করায় হত্যার পরিকল্পনা করি। তাকে টাকা দেয়ার কথা বলে খয়েরতলায় নিজের কম্পিউটারের দোকানে ডেকে ক্যাবল দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করি। পরে লাশ বাক্সে ভরে প্রথমে ভ্যানে ও পরে ইজিবাইক যোগে ফতেপুরে বাওড়ের ধারে নিয়ে গায়ে ডিজেল ঢেলে পুড়িয়ে দিই।
তবে একের পর এক খুনোখুনি ও চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরধমূলক কর্মকান্ড ঘটলেও যশোর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলছেন, অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রয়েছে।
এদিকে, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, যশোরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রধান কারণ কিশোর গ্যাং। বছর খানেক আগে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে প্রশাসনকে সতর্ক করেছিলাম। এখন সেই কিশোর গ্যাং ভয়বহ রূপ ধারণ করেছে। প্রায় দিনই হত্যাকাণ্ড, ছুরিকাঘাত, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। আর এসবের মূলে রয়েছে মাদক বেচাকেনা। দ্রুত এই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে যশোর শহরে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে।
অন্যদিকে, ২৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে যশোর রেলস্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে জুম্মান নামের এক যুবক নিহত হন।
জুম্মান হত্যায় যশোর র্যাব পা-কাটা শুভ (৩২) সবুজ (২৮) ও মোহাম্মদ (২২) নামে তিনজনকে আটক করে। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে যে ছয় মাদককারবারীকে দেখা যাচ্ছে, তারা এখনও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে। যে তিনজনকে আটক করা হয়েছে তারমধ্যে, সন্ত্রাসী ও মাদককারবারী ফুডগোডাউন এলাকার শুভ রয়েছে। এ বিষয়ে র্যাব-৬ ক্যাম্পে মুঠোফোনে ফোন করে জানতে চাওয়া হলে বলা হয়েছে- শুভ এজাহারভুক্ত আসামি।
২৬ জানুয়ারি যশোর শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক মোড়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সোলায়মান হোসেনকে। মাদকের কারবার ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন তিনি। সূত্রমতে, ঘটনার দিন ২৬ জানুয়ারি মাদক কারবারিরা প্রথমে সোহাগকে খোঁজ করে। তাকে না পেয়ে তার ভাই জসিম শিকদারকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। জসিমকে ঠেকাতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সোলায়মান।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) যশোরের সভাপতি অধ্যক্ষ শাহীন ইকবাল বলেন, যশোর শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নজিরবিহীন অবনতি ঘটেছে। শহরের নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ নাগরিকরা উদ্বিগ্ন। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতাও বেড়েছে। এতে করে যশোরে আইনশৃঙ্খা পরিস্থিতি ক্রমাগত ভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে।
যশোর পুলিশের মুখপাত্র বেলাল হোসাইন বলেন, অন্য সময়ের চেয়ে যশোরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো। যেসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে, তা পারিবারিক কলহের জেরে। হত্যাকাণ্ডের পর জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দফায় দফায় পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।
এদিকে হত্যা মামলার আসামি আটকের পাশাপাশি অস্ত্র গুলি উদ্ধারের বেশ তৎপর রয়েছে ডিবি পুলিশ। তারা গত এক বছরে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ২০টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এই সময় উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৭শ’ গুলি। কিশোর অপরাধী দমনের তৎপরতার পাশাপাশি তাদের চাকুসহ আটকের সংবাদ ছিলো লক্ষ্যণীয়। এছাড়া, বিপুল পরিমাণ মাদক দ্রব্য, বাসাবাড়ি ও দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চুরি হওয়া সোনার আলংকার ও মূল্যবান জিনিসপত্র উদ্ধার, আসামি আটক, মোবাইল ফোনসেট উদ্ধার, মোটরসাইকেল, ট্রাক, প্রাইভেটকার, ইজিবাইক, অটো রিকসা, ভ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন উদ্ধার করা হয়েছে এই সময়ে। চোরাচালান পণ্য উদ্ধার, শয়তানের নিঃশ্বাস খ্যাত বেশ কিছু অপরাধী, বিদেশি নাগরিকসহ বিভিন্ন প্রতারণা মামলার আসামি, নানা ধরনের বন্য প্রাণী উদ্ধার, প্রতারক আটক করে বেশ দক্ষতার সাথে।
ডিবি পুলিশের ওসি রুপণ কুমার সরকার বলেছেন, সারা বছরই ডিবি’র একাধিক প্রশিক্ষিত টিম নানা ধরনের অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছে। যশোর জেলায় রয়েছে ডিবির বিচরণ। নানা ধরনের সোর্স ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিবি পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ডিবির এই টিমটি আগামীতেও সকল ধরনের অপরাধ দমনে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি কাজ করে যাবে।