প্রতীক চৌধুরী
বাবা-মায়ের তিন ছেলের মধ্যে বড় কামরুল হাবিব রকি (২১)। ডিসেম্বর মাসে ঢাকার কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টে চাকরি নেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির বেইলী রোড শাখায় ক্যাশিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতে ওই রেস্টুরেন্ট ভবনে আগুন লাগলে মামা জিহাদ জোয়ারদারের ম্যাসেঞ্জারে কল দেন রকি। এ সময় শেষ কথা হয় মা রিপা বেগম ও মামা জিহাদের সঙ্গে। তখন মৃত্যুর আশংকা করে বাঁচার আকুতি জানায় রকি। রাতেই ঢাকায় চলে যান মামা জিহাদ জোয়ারদার। ফায়ার সার্ভিস রকিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে যশোর সদর উপজেলার ধোপাখোলা গ্রামের বাড়িতে তার মরদেহ পৌঁছায়। তিনি ওই গ্রামের কবির হোসেন ও রিপা বেগম দম্পতির সন্তান।
শুক্রবার সকালে নিহত কামরুল হাবিব রকির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রকির মরদেহ রাখা খাটিয়া ঘিরে স্বজন, আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের শোকের মাতম। বাবা কবির হোসেন বড় ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। আর মা রিয়া খাতুন সন্তানের শোকে বিলাপ করছেন। একটু দূরেই চেয়ারে বসে দাদী রেহেনা বেগম আহাজারি করছেন। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়েছেন আত্মীয় প্রতিবেশিরাও।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিপা বেগম বলছিলেন, ‘আমার ছেলেটারে মাদ্রাসাতে পড়িয়েছি। নামাজ কালামের উপরে থাকতো। কত আদরের ছেলে ছিলো। ও শোনা পাখি…..। তুমি (রকি) না বলেছিলে আমার ছাড়া থাকতে পারবা না। কেন তুমি আমারে ছেড়ে চলে গেলে। আমারে খুব ভালোবাসতো। আমি অসুস্থ হলে আমার সকল কাজে সহযোগিতা করতো।
আহাজারি করতে করতে তিনি আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমারে কল দিয়েছে। দিয়ে বলছে, মা আমার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লেগেছে। আমারে বাঁচাও। আমিও তারে (রকি) শান্তনা দিছি তোমার কিছু হবে না সোনা। দোয়া পড়ো সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপরেও সে বলতো লাগলো, আম্মু আমি আর বাঁচবো না। তার পরে ফোন কেটে গেল আর কিছু শুনতে পারলাম না। আর কোন কথাও হলো না। আমার সোনা আমার না রেখে কিছু খেত না। এখন কি হবে সোনা। ও আল্লাহ তুমি আমার সোনারে ফিরিয়ে দাও…। আমার সোনার বদলে আমারে নিয়ে নাও….।
নিহত রকির ভাই কামরান হোসেন সাজিম বলেন, ‘তার ভাই আলিম পাস করে গত ডিসেম্বর মাসে কাচ্চিভাই রেস্টুরেন্টে ক্যাশিয়ার পদে চাকরি নেন। বৃহস্পতিবার সেখানে কর্মরত অবস্থায় আগুন লাগে। তিনি ভবনের ভিতরে আটকা পড়েন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার মারা যান। আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়েই তার মৃত্য হয়েছে। শুক্রবার সকালে তার মরদেহ বাড়িতে এসেছে।
কামরান হোসেন সাজিম বলেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে রকি সবার বড়। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে চাকরি করে সংসারের হাল ধরেছিল। বাবা ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালায়। তাদের দুজনের আয়ে আমাদের সংসার চলত। ভাইকে এভাবে হারাতে হবে কখনো কল্পনাই করিনি।’
নিহত রকির মামা জিহাদ হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে রকির ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কল দিয়েছি, সে রিসিভ করেনি। পরে আমাকে কল ব্যাক করে বাঁচানোর আকুতি জানায়। আমাকে বলে মামা আমাদের ব্রাঞ্চে (কাচ্চিভাই বেইলি রোড শাখা) আগুন লাগছে। আমি আটকা পড়েছি। আমাকে বাঁচাও। কিছুক্ষণ পর কল কেটে যায়। আমি ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে বিষয়টি জানাই। তারা জানায় উদ্ধার কাজ চলছে, ধৈর্য্য ধরুণ। এরপর আমি ঢাকায় রওনা হই। সেখানে হাসপাতালে পাই রকিকে। ততক্ষণে তার মৃত্যু ঘোষণা করেছে ডাক্তার।
তিনি বলেন, আমিই রকিকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর চাকরির পর আমিই ঢাকা চিনিয়েছি। গত ডিসেম্বরে রকি চাকরিতে ঢুকেছে। আজ ওর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।