রেজাউল করিম, সাতক্ষীরা সংবাদদাতা
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলবর্তী জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর অঞ্চলের জনজীবনে পড়ছে নানা প্রভাব। কাজের অভাবে পুরুষ শূন্য হচ্ছে গ্রাম। লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা হচ্ছে নানা রোগে আক্রান্ত হারাচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা। নিরাপদ পানির অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরাও।
২০০৯ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। সেই সময় নারী, পুরুষ, শিশুসহ প্রাণ হারায় ৫৫ জন। দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরায় আইলার সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে বিধস্ত হয়ে বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে ওঠে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলা ।
প্রতিবছর লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারণে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্র হারিয়েছে এখানকার মানুষেরা। সেই সাথে শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে উপকূলবাসীর জন্য।
সুন্দরবনের উপর নির্ভর করে গাবুরা ও পদ্মাপুকুর ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার পরিবার জীবন যাপন করে। বছরে ৪ মাস কাঁকড়া ও মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বনে যাওয়ার পাশ না দেয়া ও বাঘের আক্রমণের ভয়ে বনজীবী পুরুষরা বউ বাচ্চা রেখে বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যান। ২০০১ সালের পর থেকে বাঘের আক্রমণে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন।
লবণাক্ততার কারণে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে শিশু ও নারীরা। জরায়ুজনিত রোগে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে নারীদের গর্ভধারণে জটিলতা হওয়ায় কমছে জন্মহার ।
শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ইউনিয়নের পার্শ্বেমারী গ্রামের মর্জিনা খাতুন বলেন, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৮ জন। এলাকায় কোন কাজ না থাকায় স্বামী ও ছেলেরা বৌ সস্তান নিয়ে পিরোজপুরে ইটভাটায় গেছে কাজ করতে। বছরের ৩ মাস বাড়ি এসে বেকার বসে থাকতে হয় তাদের সকলের।
গাবুরা গ্রামের ছকিনা বিবি বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চলা কষ্টকর হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে আমি নদীতে জাল ঠেলি এখানে থেকে মাছ ও কাঁকড়া ধরে বিক্রি করি। প্রতিদিন লোনা পানিতে দীর্ঘ সময় থাকার কারণে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দেয়। আমার মতন অনেক নারী নদীতে জাল টেনে জীবিকা নির্বাহ করে।
একই ইউনিয়নের সোলাইমান গাজী বলেন, আমাদের এখানে নানা সমস্যা নিয়েই জীবনযাপন করতে হয়। বিশেষ করে সুপেয় খাবার পানির কষ্ট। স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র থাকলেও কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে নদীর ওপার ২০ কিলোমিটার দূরে শ্যামনগর উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেতে হয়।
স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী আরিফা খাতুন বলেন, আশাশুনি উপজেলার, প্রতাপনগর, শ্রীউলা,আনুলিয়া, খাজরা ও শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মাপুকুর ইউনিয়নে লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার শিকার এখানকার নারীরা। পানি বাহিত রোগের কারণে নারীদের জরায়ু টিউমার, জরায়ু ক্যানসারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগতে হয় এখানকার নারীদের।
স্বদেশের নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ দত্ত বলেন, আদমশুমারী অনুযায়ী শ্যামনগরে পুরুষের হার কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের সার্ভাইকাল ক্যান্সার হচ্ছে। জরায়ুর বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। এখানে পর্যাপ্ত নিরপাদ পানির অভাব রয়েছে। কাজের অভাবে এ অঞ্চলের পুরুষেরা কাজের জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। লবণ পানি রোধ করে কৃষি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারলে এ অঞ্চলের মানুষরা পূর্বের মত জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, টেকসই বেড়িবাঁধ আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল সরকারের কাছে। ইতিমধ্যেই গাবুরাতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষের পথে। টেকসই বেড়িবাঁধ হয়ে গেলে নদী থেকে লবণ পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে। আগের মত সবুজ শ্যামলে ভরে উঠবে গাবুরা ইউনিয়ন। সেখানে ফসল উৎপাদন হবে, তৈরি হবে মানুষের কর্মসংস্থান। তিনি আরও বলেন, বনজীবীদের সন্তানদের মধ্যে যারা স্কুল গমনের উপযোগী তাদের শতভাগ যাতে স্কুলে যেতে পারে তার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে, প্রেরণা জুগিয়ে অথবা প্রণোদনা মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হবে।