‘সংগঠনকে গতিশীল করতে সদরে কাজ করছি। হেডকোয়ার্টার
শক্ত থাকলে, বাকি উপজেলাও শক্তিশালী হবে’- শাহীন চাকলাদার
হাসান আদিত্য
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন এমপি শাহীন চাকলাদার। চমক দেখিয়ে জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আজিজুল ইসলাম ওরফে খন্দকার আজিজ বিজয়ী হন। পরাজিত হওয়ার পর কেশবপুরের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন শাহীন। এখন তিনি পুরোদমে সদরের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেছেন। তারই প্রথম ধাপ হিসাবে উপজেলার চেয়ারে বসাতে চান তারই চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুকে। নিজ প্রার্থীকে বিজয়ী করার মধ্যে দিয়ে আবারও সদরের রাজনীতিতে আধিপত্যের প্রর্তবতন করতে চান জেলার এই শীর্ষ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য।
শুধু শাহীন চাকলাদার নয়; যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের সাবেক এমপি স্বপন ভট্টাচার্য, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সাবেক এমপি রণজিত রায়, যশোর-২ (ঝিকরগাছা- চৌগাছা) আসনের সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম ও ডা. মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন উপজেলার রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্বের রক্ষার লড়াই হিসেবে বেছে নিয়েছেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কেউ কেউ কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। আবার কেউ কেউ কৌশলে প্যানেল ঘোষণা করে অনুসারীদের মাঠে নামিয়েছেন। ইতোমধ্যে সাবেক এমপি স্বপন ভট্টাচার্য পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পেরে বেজাই খুশি। জয় উদযাপনে শামিল হয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে বক্তব্যও দিয়েছেন।
রাজনীতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক এই পাঁচ সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত ও পরাজিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে উপজেলার রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। সংকটে পড়েছিলেন অস্তিত্বের। তারা এই উপজেলা নির্বাচনে সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করার মধ্যে দিয়ে রাজনীতির আধিপত্যের প্রত্যার্বতন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
কেশবপুর ছেড়ে সদরে সরব শাহীন চাকলাদার:
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যশোর-৬ (কেশবপুর) দলীয় মনোনয়ন পেয়েও পরাজিত হন তৎকালীন সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। চমক দেখিয়ে বিজয়ী হন উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আজিজুল ইসলাম ওরফে খন্দকার আজিজ। পরাজিত হওয়ার পর কেশবপুরে তেমন কোন দলীয় কর্মসূচিতে দেখা যায়নি শাহীন চাকলাদারকে। নেতাকর্মীরা বলছেন, পরাজিত হওয়ার পর কেশবপুরের রাজনীতিতে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন শাহীন চাকলাদার। তবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে বেছে নিয়েছেন সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। সদর উপজেলায় শাহীন চাকলাদারের বেশ প্রভাব রয়েছে, রয়েছে অনেক অনুসারী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে এই উপজেলার টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে কেশবপুরের সংসদ সদস্য হওয়ার পর সদরের রাজনীতিতে কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তাই এখন আবারও সদরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে চান জেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা। তারই প্রথম ধাপ হিসাবে উপজেলাতে বসাতে চান তারই চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুকে। শাহীন চাকলাদারের এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন খোদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন। তবে শাহীনের সদরে প্রত্যার্বতনের যে চেষ্টা, তাতে ছাড় দিতে নারাজ তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বি স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তিনিও উপজেলা দখলে রাখতে ইতোমধ্যে প্যানলে ঘোষণা করেছেন। তিনিও বর্তমান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুলকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসাবে সমর্থন দিয়েছেন। সদরের রাজনীতিতে শাহীনের প্রর্তবতনের এই অস্থিত্বের লড়াইয়ে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও নাবিল- শাহীন মুখোমুখি হয়েছেন।
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘কেশবপুর আওয়ামী লীগে অনৈক্য। তাই ওখানে আর যায়নি। সদর ছেড়ে কেশবপুরে চলে যাওয়ায় সদরের দলের সাংগঠনিক গতিশীলতা নেই বলেই চলে। তাই সংগঠনকে গতিশীল করতে কাজ করছি। এ নেতার ভাষ্য-হেডকোয়ার্টার যদি শক্ত থাকে, বাকি উপজেলাগুলোও শক্তিশালী হবে।
তিনি বলেন, সদরে অনেক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এখানে ফন্টু ছাড়া কেউ আমার কাছে আসেনি। প্রার্থীরা যদি আমাকে না ডাকে, সেখানে তো আমরা যেতে পারি না। তাই আমি তার হয়ে নির্বাচনী সমাবেশ করছি। কর্মীসভা করছি, এর মাধ্যমে নেতাকর্মীরা উজ্জবিত হচ্ছে। সাংগঠনিক গতিশীলতা পাচ্ছে। আমার কাজ সংগঠনকে শক্তিশালী করা।’
ঝিকরগাছায় মনিরুলকে ঠেকাতে একাট্টা মনির-নাসির:
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন দশম সংসদের সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন নৌকার প্রার্থী ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিনের কাছে। আর একাদশ সংসদের এমপি ডা. নাসির উদ্দিন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে অংশই নেননি। ক্ষমতায় না থাকায় উপজেলার রাজনীতিতে সংকটে পড়েছেন ওই দুই সাবেক সংসদ সদস্য। তাই ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে ঠেকাতে একাট্টা হয়েছেন সাবেক এমপি অ্যাড. মনিরুল ইসলাম ও ডা. নাসির উদ্দিন। বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বিজয়ী হলে বর্তমান সংসদ ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিনের রাজনৈতিক ভিত আরও মজবুত হবে। এমন শংকায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সেলিম রেজার ঘোড়া প্রতীককে বিজয়ী করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে মনির-নাসির। তাদের সঙ্গে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল ও সাধারণ সম্পাদক মুছা মাহমুদও। যদিও সেলিম রেজা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন, তিনি ডা. নাসির উদ্দিনের মাইম্যান হিসেবে পরিচিত। আর বিগত ৫ বছর ডা. নাসির ও মনিরুল অনুসারীদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। সেই অতীত ভুলে তারা এখন চেয়ারম্যান মনিরুলকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
নেতাকর্মীরা জানান, এক দশকের বেশি সময় ধরে ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগে দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন সাবেক সংসদ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। অপরটি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ডা. নাসির দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলে উপজেলার চেয়ারম্যান মনিরুলের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। সম্পর্কের অবনতি হলে দায়িত্বেও দুই বছর পর নাসির ও মনিরুল আর একসঙ্গে রাজনীতি করেনি। তখন উপজেলা আওয়ামী লীগ তিন খন্ডে বিভক্ত হয়।
সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান মনিরুল বর্তমান সংসদ ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিনকে সমর্থন করে ভোট করেন। নৌকার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন সাবেক এমপি অ্যাড. মনিরুল। পরাজিত হয়ে এক প্রকার উপজেলার রাজনীতি থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েন সাবেক এমপি মনিরুল। আর সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন ডা. নাসির। বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিন ও উপজেলার চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম একই বলয়ে থাকায় রাজনীতির ভিত্তি মজবুত হয়েছে। এমন পরিস্থিতি নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষার স্বার্থে সাবেক দুই এমপি এক হয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী সেলিম রেজাকে সমর্থন দিয়ে তারা আবারও রাজনীতিতে আধিপত্যের প্রত্যার্বতন ঘটানোর চেষ্টা করছেন।
এই বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল বলেন, ‘নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে সাবেক দুই এমপি এক হয়েছেন। এখানে কাউকে পরাজিত করতে এক হয়েছে এমনটি ভুল।’
রণজিতের অস্তিত্বের লড়াইয়ে ছেলে প্রার্থী:
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের পরপর তিনবারের সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায় এবার নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও ভোট গ্রহণের কিছুদিন আগে তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এনামুল হক বাবুলকে সমর্থন নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। টানা তিনবারের সংসদ সদস্য রনজিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার চেয়ারে না বসে পেরে বাঘারপাড়া উপজেলার রাজনীতিতে ভাটা পড়তে থাকে। দীর্ঘদিনের রাজনীতি সহচররা ভিড়তে থাকে বর্তমান সংসদ বাবুলের ডেরাতে। এতে যতই দিন যেতে থাকে উপজেলার রাজনীতিতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। এমন পরিস্থিতি উপজেলার পরিষদ দখলে রাখতে ছেলে যুবলীগের আহ্বায়ক রাজীব রায়কে চেয়ারে বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে রনজিত। যদিও এই চেয়ার দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহজ হবে না রনজিতের। বর্তমান সংসদ সদস্য এনামুল হক বাবুলের সমর্থিত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বিপুল ফারাজীর সঙ্গে তার লড়তে হবে মনে করছেন উপজেলার তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
পছন্দের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় উজ্জীবিত স্বপন ভট্টাচার্য:
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুইবারের সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য গেল সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হন এই আসনের নতুন প্রার্থী জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি এসএম ইয়াকুব আলীর কাছে। নতুন মুখের কাছে এই হেভিওয়েট প্রতিমন্ত্রী ধরাশায়ী হওয়ার পর উপজেলার রাজনীতি অনেকটা একপেশে হয়ে যায়। ভাটা পড়ে স্বপনের রাজনীতি। ঘুরে দাঁড়ানোর পথ বেঁচে নেন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। গেল ৮ মে শেষ হওয়া উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে বাছাই করেন সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলুকে। এই প্যানেলের বিপরীতে বর্তমান এমপি ইয়াকুব আলীও প্যানেল ঘোষণা করেন। তিনি চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনকে সমর্থন করেন। নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বিজয়ী হয় স্বপন সমর্থিত প্রার্থী লাভলু। নির্বাচনের একদিন পরেই উপজেলাতে বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে নেতাকর্মীদের সমাগম ঘটিয়ে করেছেন বিজয় মিছিল ও সমাবেশ। সেই সমাবেশে স্বপন বর্তমান সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলীকে ইঙ্গিত করে নানা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তবে এটি বিজয় মিছিল নামে স্বপনের শক্তির মহড়া ও মধুর প্রতিশোধ উদযাপন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। তাদের ভাষ্য, উপজেলা পরিষদে নিজ সমর্থিত প্রার্থীকে বসানোর মধ্যে দিয়ে আবারও মণিরামপুরের রাজনীতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন স্বপন।
পরাজিত হওয়ার পরে রাজনীতিতে ভাটা পড়েনি দাবি করে স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘আমি পরাজিত হয়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। নেতাকর্মীরাও আমার পাশে ছিলো। পরাজিত হয়েছিলাম কালোটাকা, কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে। এখনো উপজেলাতে আমার জনপ্রিয়তা রয়েছে, নেতাকর্মীও রয়েছে। নিজেদের ভিতর নির্বাচন হওয়াতে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব গ্রুপিং হচ্ছে, থাকবে। কিন্তু জনগণের সমর্থন কোন দিকে সেটাই মূল বিষয়।’