♦ মামলার বিচারে ধীরগতি
♦ ধরা পড়ে বাহক, সাজা হলেও পলাতক আসামি
♦এক পিস সোনা পাচারে কাজ করেন ৩০-৪০ জন
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
২০২৩ সালের যশোরের শার্শার অগ্রভুলোট বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা পাঁচভুলোট গ্রামের নয়কোনা বটতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী আব্দুর রাজ্জাককে আটক করে। এ সময় তার স্বীকারোক্তিতে মোটরসাইকেলের চেসিসের নিচে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা ৬৩ পিস সোনার বার (যার ওজন ৭ কেজি ৩৩৭ গ্রাম) উদ্ধার করা হয়। এ ব্যাপারে বিজিবির হাবিলদার নাসিম মোল্যা বাদি হয়ে চোরাচালান দমন আইনে শার্শা থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে রাজ্জাককে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশ। তার কাছ থেকে চক্রের অন্য সদস্যদের বিষয়ে কোনো তথ্যই বের করা যায়নি। রাজ্জাক পুলিশকে জানায়, কাটআউট পদ্ধতিতে চোরাচালান হয় বলে কেউ কারো পরিচয় জানে না। আদালতে ১৬৪ ধারায় তার দেয়া জবানবন্দিতে তাই তথ্য মেলেনি।
এর তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ২০ মে শার্শা থানা পুলিশ সংবাদ পায় সামটা জামতলা এলাকায় পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই সংঘটিত হয়েছে। পরে এ ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এসআই আবুল হাসান ঘটনাস্থলে যেয়ে জানতে পারেন বাগআঁচড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুইজনকে আটক করে নিয়ে গেছে। পরে তারা শার্শা থানায় আটক সাজেদুর ও আক্তারুলকে হাজির করে। আটক দুইজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৮ পিস সোনার বার (যার ওজন ৮৫ ভরি)। এ ঘটনায় তৎকালীন এসআই (বর্তমানে চাকরিচ্যুত) আবুল হাসান বাদী হয়ে শার্শা থানায় চোরাচালান দমন আইনে মামলা করেন। এ ঘটনায় মামলার পর তদন্ত হলেও কিছুই বের করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ পরে পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পায়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই দুইজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ চার্জশিট জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এসব মামলাগুলো বিচারধীন।
সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে স্বর্ণ আটকের ঘটনায় অন্তত ৬০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার প্রায় অর্ধেকের বেশি বিচারাধীন এবং মামলার বিচার এক যুগের বেশি সময় ধরে চলছে। আবার বেশির ভাগ আসামিরা জামিনে রয়েছে। মামলার যেগুলো সাজা হয়েছে প্রত্যেকই সোনা বহনকারী। এখনো অধরা গডফাদাররা। এ ছাড়া এসব মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই। যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সোনাচালানসহ সকল পুরানো মামলার কাজ শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিচারবিভাগ। দ্রুতই সোনাচালান মামলার সাক্ষী শেষ করে মামলার কাজ শেষ করবে। তিনি জানান, সাক্ষীর অভাবে এসব মামলার কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক সবাই তদন্ত কর্মকর্তাদের রিপোর্ট জমা দিতে না পারার কারণে মামলার বিচারে এই ধীরগতি।’
কেন বিচারে ধীরগতি ?
মামলার বিভিন্ন ধাপে যুক্ত ব্যক্তি ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলা করার পর তদন্ত ও বিচারের প্রতিটি ধাপে ভিন্ন ভিন্ন কারণে দেরি হয়। স্বর্ণ চোরাচালান উদ্ধার হওয়ার পর মামলায় স্থানীয়দের সাক্ষি করা হয়। বেশির ভাগই মামলায় পরবর্তীতে এসব সাক্ষিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন না। এতে মামলার অভিযোগপত্র গঠনে দেরি হয়। বিচার শুরুর পর লম্বা বিরতি দিয়ে শুনানির তারিখ ধার্য হয়। সাক্ষীকে হাজির করাও কঠিন হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য পেতে সবচেয়ে দেরি হয়। বিশেষ করে তারা বদলি হয়ে গেলে তাদের সাক্ষ্য পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়।
এই বিষয়ে পিপি ইদ্রীস আলী বলেন, ‘মামলার চাপে দেরি করে তারিখ ধার্য হয়। অনেক সময় সাক্ষী আসে না। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব প্রসিকিউশনের। অনেকে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী থাকেন না। আদালত সমন জারি করলে অনেক সময় সাক্ষীকে ধরে আনতে হয়।
এক পিস সোনা পাচারে কাজ করেন ৩০-৪০ জন:
স্বর্ণ চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে যশোর। এ জেলা থেকে প্রতিনিয়িত পাচার হচ্ছে স্বর্ণ। চোরাচালান ঠেকাতে প্রশাসনের তেমন কার্যকর তৎপরতা দেখা যায় না। যেটুকু উদ্ধার হয় তা বিজিবি সদস্যরা করে থাকেন। বৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিজিবি বা কাস্টমসের হাতে যে স্বর্ণ উদ্ধার হয় তার ২০ গুণ সোনা পাচার হয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সীমান্তে একের পর এক সোনা উদ্ধার ও জব্দের ঘটনা ঘটছে। কখনো গাড়িতে বিশেষ কায়দায়, কখনো পেটের ভেতর বা পায়ুপথে, নারীদের গোপনাঙ্গে, স্যান্ডেল-জুতার ভেতরে নানা কায়দায় সোনা পাচার করা হচ্ছে। অনেক সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় কেজি কেজি সোনা উদ্ধার করা হচ্ছে।
চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করা একাধিক সূত্র জানায়, এক পিস সোনার বার দেশের কুমিল্লা, চট্টগ্রাম বা ঢাকা যে পথেই প্রবেশ করুক না কেন পাচার হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে অন্তত ৩০-৪০ জন কাজ করেন। কেউ বাহক, কেউ লাইনম্যান, কেউবা ইনফরমার। আবার কেউ কেউ বাহক বা লাইনম্যান ও ইনফরমারের ওপর গতিবিধি অনুসরণের কাজ করেন। প্রতি পিস বার পাচারের জন্য মূল হোতা পাচার কাজে নিয়োজিত একজনকে দায়িত্ব দেন। এজন্য তাকে দেয়া হয় তিন হাজার টাকা করে। ওই টাকা থেকে বাহকসহ রাস্তায় নিয়োজিত ওয়াচম্যানদের দেয়া হয় এক হাজার। ওয়াচম্যানরা বিভিন্ন মোড়ে বা রুটে নির্দিষ্ট এরিয়ায় কাজ করেন। বিজিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ আসছে কি না বা ওই রুটে সামনে কোনো বিপদ আছে কি না তা নির্দিষ্ট একটি বা দুটি মোবাইল নম্বরে জানিয়ে দেন তারা। তবে এর আগের বা পরের জন কে তা তারা জানতে পারেন না। তেমনি মূলহোতা কারা তাও তাদের জানতে দেওয়া হয় না।
তারা শুধু নির্দিষ্ট সময় তথ্য দিয়ে সহায়তা করের এবং তাদের ভাগের টাকা যথাযথভাবে বুঝে নেন। সে টাকাও গ্রহণ করতে হয় অপরিচিত মাধ্যম থেকে। এজন্য মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। উদ্ধারের বাইরে সীমান্তের বিভিন্ন চোরাচালানি ঘাট ও আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে দীর্ঘদিন বিপুল পরিমাণ সোনার বার ভারতে পাচার করেছেন এক শ্রেণির চোরাকারবারি ও বহনকারীরা। তবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এসব অভিযানে শুধু বহনকারী শ্রমিকই আটক হয়েছেন। সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন মূল হোতারা। কয়েকটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিজিবি ও যশোরের কয়েকটি থানার দেওয়া তথ্যমতে, খুলনা বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে সীমান্ত এলাকা রয়েছে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরায়। এসব সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন সোনার বড় বড় চালান পাচার হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
কেন অধরা রাঘববোয়াল :
এই বিষয়ে ৪৯ বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল আহমেদ হাসান জামিল বলেন, ‘সোনাসহ বিভিন্ন চোরাচালান রোধে বিজিবি সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে আমাদের গোয়েন্দা দল কাজ করছে। সোনা চোরাচালানে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের ছাড় দেয়া হবে না।’
তিনি জানান, বিজিবি অভিযান চালিয়ে সোনা জব্দ করে ও আসামির বিরুদ্ধে মামলা দেয়। এরপর এসব মামলার তদন্তভার পুলিশের ওপর বর্তায়। নেপথ্যে থাকা চোরাকারবারিকে সামনে আনবে তদন্তকারী ইউনিট। এরপরও বিজিবি সজাগ ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আর যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘স্বর্ণ চোরাকারবারিদের রিমান্ড চেয়ে চালান দেয়া হয়। রিমান্ডে বহনকারীরা মুখ না খোলায় এবং পর্যাপ্ত তথ্য না দেয়ায় রাঘববোয়ালরা পার পেয়ে যান। এ ছাড়া তথ্য পেলেও পর্যাপ্ত প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যান রাঘববোয়ালরা’।