♦ দলীয় রেষারেষির কারণে শার্শা-ঝিকরগাছায় সংঘাতের আশঙ্কা
♦ ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো বড় চ্যালেঞ্জ
♦ ইভিএমে ভোটগ্রহণ
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের শার্শা, চৌগাছা ও ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে পছন্দের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে নেতাকর্মীরা। নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণের মধ্যে তিন উপজেলায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে। ভোটকেন্দ্র দখল ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং দলীয় রেষারেষির কারণে ভোটের দিন বিশেষ করে শার্শা ও ঝিকরগাছার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে।
হাড্ডাহাড্ডির লড়াই আর শঙ্কার মধ্যে মঙ্গলবার ইভিএমে তিন উপজেলার প্রার্থীদের ভাগ্যনির্ধারণ হবে। তবে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোয় বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই তিন উপজেলায়। সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন।
জানা যায়, ঝিকরগাছার বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে ঠেকাতে একাট্টা হয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য। তারা প্রকাশ্যে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী সেলিম রেজার পক্ষে মাঠে নেমেছেন। চৌগাছা বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ড. মোস্তানিছুর রহমানকে ঠেকাতে মরিয়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম হাবিবুর রহমান। শার্শায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের মনোনিত প্রার্থী সোহরাব হোসেনকে ঠেকাতে মাঠে রয়েছেন সাংসদের আরেক দুই অনুসারী অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল এবং অহিদুজ্জামান অহিদ। এই তিন প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন উপজেলার প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মিন্নু। তার পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অনেকে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যভাবে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।
যশোরের শার্শা, ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের ৮টি (একটি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) পদে ২৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চৌগাছায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে শামীম রেজা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ইভিএম-এ ২৯৩টি কেন্দ্রের ২১৭৩টি কক্ষে এদিন ভোট দেবেন ভোটাররা। উপজেলা তিনটিতে মোট ভোটার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭১১।
শার্শায় ১০২ কেন্দ্রে ২ লাখ ৯৯ হাজার ১১১ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। তারা হলেন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মিন্নু (মোটরসাইকেল), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল (ঘোড়া), উপজেলা যুবলীগের সভাপতি অহিদুজ্জামান অহিদ (আনারস) এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন (দোয়াত কলম)।
ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আব্দুর রহিম সরদার (তালা), সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সরদার সাহরিন আলম বাদল (টিউবওয়েল), যুবলীগ নেতা তরিকুল ইসলাম মিলন (টিয়া পাখি) এবং শফিকুল ইসলাম মন্টু (চশমা)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনজন। তারা হলেন বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আলেয়া ফেরদৌস (হাঁস), নাজমুন নাহার (ফুটবল) এবং জেলা যুবমহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা আলম সালমা (কলস)। নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, আব্দুল মান্নান মিন্নু ছাড়া চেয়ারম্যান পদের অপর তিনজন প্রার্থী স্থানীয় রাজনীতিতে এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত।
যে কোনো কর্মসূচি থেকে এমপির ব্যক্তিগত ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদিতে ছায়ার মতো সঙ্গ দিতেন অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল, অহিদুজ্জামান অহিদ এবং সোহরাব হোসেন। ফলে, একই পক্ষ থেকে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ায় এমপি শেখ আফিল উদ্দিন একটু অস্বস্তিতেই পড়েছেন বলে মনে করছেন তার সমর্থকেরা। যদিও, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন নিজেকে এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন।
সোহরাব হোসেনকে এমপির সমর্থিত প্রার্থী ঘোষণাতে চটেছেন অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খলিল এবং অহিদুজ্জামান অহিদ। তারাও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। সেই সুযোগটি নিতে চাচ্ছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিক আব্দুল মান্নান মিন্নু। তার পক্ষে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের অনেকে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যভাবে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী ও কর্মী সমর্থকদের মধ্যে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটকেন্দ্র দখল ও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা এবং দলীয় রেষারেষির কারণে ভোটের দিন বিশেষ করে উপজেলার সকল কেন্দ্র অতিগুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নত করেছে।
ঝিকরগাছা উপজেলায় ১১০টি কেন্দ্রে দুই লাখ ৬৩ হাজার ১৬৮জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম, বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান লুবনা তাক্ষী, বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সেলিম রেজা ও রেজাউল হোসেন লড়ছেন । ভাইস চেয়ারম্যান পদে সৈয়দ ইমরান রশিদ, কামরুজ্জামান মিন্টু ও ইদ্রিস আলী বিশ্বাস, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাহানা আক্তার, জেসমিন সুলতানা, আমেনা খাতুন ও আছিয়া বেগম প্রার্থী হয়েছেন।
এই উপজেলায় নির্বাচনী উত্তাপ ছড়িয়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে। বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সাবেক দুই এমপি অ্যাড. মনিরুল ইসলাম ও ডা. নাসির উদ্দিন। তারা দুইজন চেয়ারম্যান প্রার্থী সেলিম রেজার পক্ষে মাঠে নেমেছে। এই প্রার্থীকে ঘিরে স্থানীয় রাজনীতিতে নয়া সমীকরণ তৈরি হয়েছে। তবে তৃণমূলের সঙ্গে যার নিবিড় সম্পর্ক তিনিই বিজয়ের মালা পরবেন।
ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তৃণমূলের সঙ্গে রাজনীতি করছি। তৃণমূলের মানুষের দুঃসময়ে আমি পাশে থেকেছি। তাদের ভোটেই গতবার বিজয়ী হয়েছিলাম। এবারও তৃণমূল আমাকে নির্বাচিত করবে। সাবেক সংসদ সদস্যরা যতই জোট করুক আমাকে পরাজিত করতে পারবে না।
এদিকে, চৌগাছা উপজেলায় ৮১টি কেন্দ্রে এক লাখ ৯৯ হাজার ৪৩২জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। চেয়ারম্যান পদে বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ড. এম মোস্তানিছুর রহমান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা এসএম হাবিবুর রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আকলিমা খাতুন লাকি, নাছিমা খাতুন, বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজনিন নাহার, যুব কামরুন্নাহার শাহিন ও রিপা ইসলাম। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম রেজা। এই উপজেলাতে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে তুমুল লড়াইয়ের আভাস মিলেছে। দুই প্রার্থীকে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মরিয়া দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে যশোরে পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, প্রত্যেক ভোটার যেনো নিরাপদে ভোট কেন্দ্রে আসতে পারেন, স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন বদ্ধপরিকর। ভোটারদের যদি কেউ কেন্দ্রে আসতে বাধা দেয় কিংবা ভোট নিয়ে কোনো ধরনের পরিবেশ বিনষ্টের চেষ্টা করে তাহলে তা আইনানুগভাবে দমন করা হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ, বিজিবি, আনসার, র্যাব সদস্যরা ভোটারদের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে। কেউ ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে বাঁধা প্রদান করলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’