হাসান আদিত্য
সদর উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই। সদরের রাজনীতিতে শাহীনের আধিপত্যে যে ভাটা পড়েছিলো দীর্ঘদিন; সেটা তার ভাইয়ের বিজয়ের মধ্য দিয়ে ফিরে পেলেন। অন্যদিকে শাহীনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি কাজী নাবিল আহমেদের সমর্থিত প্রার্থী পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে উপজেলার রাজনীতিতে অনেকটা নড়বড়ে হয়েছেন বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থধাপে সদর উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ হয়। নির্বাচনে ১৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফলে যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ৫৭ হাজার ৯১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি ঘোড়া প্রতীকের ফাতেমা আনোয়ার পেয়েছেন ৫৫ হাজার ৬১০ ভোট। যশোরের রাজনীতিতে দুটি ধারা দীর্ঘদিনের। একটি ধারার নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। অন্যটি নিয়ন্ত্রণ করেন যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ কাজী নাবিল আহমেদ। নির্বাচন কেন্দ্র করে আবারও শাহীন-নাবিল মুখোমুখি হয়। তারা পৃথকভাবে দুটি প্যানেল ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত ফলাফলে বিজয়ী চেয়ারম্যান ও পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান শাহীনের অনুসারী। আর বিজয়ী মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নাবিলের অনুসারী।
দলীয়সূত্রে জানা গেছে, শাহীন ও নাবিলের বিরোধ এক দশকের। মূলত সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন আর আধিপত্য ঘিরেই তাদের দ্বন্দ্ব। এখানে টানা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য নাবিল। অন্যদিকে শাহীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে টানা তিন বারের উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু উপজেলা ছেড়ে শাহীন ২০২০ সালে উপনির্বাচনে যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে সংসদ নির্বাচিত হন। সদর ছেড়ে শাহীন কেশবপুরে গেলে সদরের রাজনীতিতে ভাটা পড়ে শাহীনের। দীর্ঘদিনের শাহীনের অনুসারীরা ভেড়েন নাবিলের ডেরায়। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি। সদর আর কেশবপুর দুটি উপজেলা ক্ষমতার কর্তৃত্ব হারিয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসে শাহীনের রাজনীতি। এমন পরিস্থিতিতে আবারও সদরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করেন তারই চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুকে। ফন্টুকে বিজয়ী করতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলনসহ জেলা ও সদরের একংশের নেতাকর্মীদের নিয়ে আদাজল খেয়ে নামেন ভোটের মাঠে। অবশেষে সফলও হয়েছেন শাহীন। দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়েছেন।
অন্যদিকে, নাবিল উপজেলাতে তার অবস্থান ধরে রাখতে নিজের অনুসারী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুলকে সমর্থন দেন। বিপুলকে বিজয়ী করতে দলের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশও দেন। বিপুলকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন নাবিলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বর্তমান চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, সদ্য বহিস্কৃত যুব মহিলালীগ নেত্রী ফাতেমা আনোয়ার। নাবিল অনুসারীদের মধ্যে একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী হওয়ায় গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা। এই দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী নাবিল অনুসারী হিসেবে পরিচিত শীর্ষ বেশকিছু নেতাকর্মী নিয়ে নাবিলের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন তারা। এর মধ্যে নাবিলের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন বিপুল। প্রার্থী পরাজয় আর দীর্ঘদিনের রাজনীতি অনুসারীরা ছেড়ে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে উপজেলার রাজনীতিতে অনেকটা নড়বড়ে অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে নাবিলের বলে মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের পাঁচজন নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। শাহীন চাকলাদার দলের সেক্রেটারি এবং উপজেলার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সদরের বেশিরভাগ চেয়ারম্যান তার সঙ্গে ছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীও ছিলেন বেশ। শাহীন যখন সদর ছেড়ে কেশবপুরে যান তখন সদরের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও শীর্ষনেতারা উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্প বঞ্চিত হওয়া শুরু করেন। পরবর্তীতে শাহীনের দীর্ঘদিনের সদরের রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিরা শাহীনকে ছেড়ে নাবিলের ডেরাতে চলে যান। যারা নাবিলের ডেরায় যায়নি; তারা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়েছিলেন। এখন আবার শাহীন উপজেলার রাজনীতিতে ফেরাতে এক সময়ের সদরের নিষ্ক্রিয়রা সক্রিয় হয়েছেন। এবার শাহীনের ভাই চেয়ারম্যান হওয়ায় নতুন করে ভিত গড়েছেন শাহীন। একসময়ে শাহীনের জনপ্রতিনিধি ও অনুসারীরা আবারও তার ডেরায় ফিরেছেন।
অন্যদিকে, উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বিপুলকে সমর্থন দেয়ায় নাবিলের দুই প্রভাবশালী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তারা দুইজনের নাবিলের জেলা উপজেলার কিছু নেতাকর্মী নিয়ে তার সঙ্গ ছেড়েছেন। প্রার্থী পরাজয় আর দীর্ঘদিনের রাজনীতি অনুসারীরা ছেড়ে চলে যাওয়াতে নাবিলের রাজনীতি এখন অনেকটা নড়বড়ে। এছাড়া দ্বন্দ্বে বিভক্তিতে জড়ানো নাবিল অনুসারীদের বেশ কিছু সিনিয়র নেতাকর্মীরা নাবিলকে এড়িয়ে চলছেন। চেষ্টা করছেন তৃতীয় বলয় সৃষ্টি করার।
এই বিষয়ে কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করে করে মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, ‘সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ার হারিয়ে নাবিল আহমেদের রাজনীতি অনেকটা হালকা হয়ে গেছে এটা সত্যি। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। জয় পরাজয় থাকবেই। মনোক্ষুণ্ন হওয়াতে অনেকেই অখুশি হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন। রাজনীতিতে নেতাকর্মীরা যাওয়া আসার মধ্যে থাকে। এটাও রাজনীতির কৌশল। তবে এটার কোন প্রভাব পড়বে না।
আর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘পদ-পদবি না থাকলেও তৌহিদ চাকলাদার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে। তৃণমূলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সে প্রার্থী হয়েছিলো। এখানে আমার আধিপত্য কোনো বিষয় নয়। জনগণ চেয়েছে তাই সে নির্বাচিত হয়েছে।’