নড়াইল সংবাদদাতা
মাসখানেক আগেও যে বিলে ফসল ফলত। কৃষকের স্বপ্ন ঘিরে থাকত বিলের ফসলে। সেখানে রাতারাতি গড়ে উঠছে পাকা-আধাপাকা বসতি। করা হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, কাটা হচ্ছে পুকুরও। আবার সেই কোথাওবা নির্মাণ শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনা।
হটাৎ করে এসব কর্মযজ্ঞ কোন সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টারের জন্য নয়। বরং সরকারের টাকা লুটের পাঁয়তারার অংশ।
নবকর্মযজ্ঞের এই এলাকা দিয়ে ভাঙ্গা-নড়াইল-বেনাপোল মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা প্রকাশ হওয়ার পরই এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। আর এতেই যেন আলাদিনের চেরাগ দেখে এলাকাবাসী। জমির মূল্য বেশি য়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতানোর ফন্দি হিসেবে চলছে এই কর্মযজ্ঞ। সাজানো এসব স্থাপনা দেখা গেছে সম্ভাব্য সড়কটির নড়াইল অংশে শহরের বাইপাস (মাছিমদিয়া, ধোপাখোলা, দক্ষিণ নড়াইল, বাঁশভিটা ও সীতারামপুর) এলাকায়।
২০২৩ সালে ভাঙ্গা-নড়াইল-বেনাপোল মহাসড়কের দু’পাশে সার্ভিস লেনসহ ছয় লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৬ হাজার ১৪০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রকল্পটি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্প এলাকা গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, কাশিয়ানী উপজেলা, নড়াইলের লোহাগড়া ও সদর উপজেলা এবং যশোরের বাঘারপাড়া, সদর উপজেলা, ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার বেনাপোল পর্যন্ত।
সরেজমিন ধোপাখোলা ও দক্ষিণ নড়াইল মৌজার দুটি বিলে দেখা গেছে, রাস্তা না থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক কৃষকের ফসলি জমি মাড়িয়ে বিলের মধ্যে ইট, বালু, সিমেন্ট, রড বহন করে ঘরবাড়ি নির্মাণ ও ভেকু মেশিন দিয়ে পুকুর খনন করা হচ্ছে। মাঠের মধ্যে যেখানে চলাচল কষ্টসাধ্য, সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে নির্মাণ সামগ্রী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অন্য কৃষকরাও। তাদের আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে; পাড় ভেঙে যাচ্ছে, ফসল মাড়িয়ে চলছে যানবাহন। এ পথে নতুন মহাসড়ক হওয়ার ম্যাপ ফাঁস হওয়ার পর এসব স্থাপনা তৈরি শুরু করেছেন স্থানীয় বাবুল আক্তার, মো. কামরুজ্জামান, মনির মোল্লা, শফি মোল্যাসহ স্থানীয় অনেকেই। কিছু লোক আবার রাস্তা হওয়ার খবর পেয়েই রাতারাতি অনেক জমি কিনে নিয়েছেন। অনেক কৃষককে তাদের ভূমি বিক্রি করতে বাধ্যও করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিল দুটিতে ফসলি জমি নষ্ট করে প্রায় অর্ধশত স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, অন্য জমির সীমানা ঘেঁষে মাঠের মধ্যে ২০টির মতো পুকুর খনন করা হয়েছে এবং প্রায় ১০টি ফসলি জমিতে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। তবে এর সবই অস্থায়ী; নড়বড়ে ভিত্তির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। সামান্য ঝড় বা একটু বেশি বৃষ্টি হলেও ধসে গিয়ে ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। অধিক ক্ষতিপূরণের লোভে সাইনবোর্ড টানানোর মতো, ঘর ও স্থাপনাগুলো শুধু দাঁড় করানো হচ্ছে।
ধোপাখোলা গ্রামের কৃষক বাবলু বলেন, ‘৪৪ শতাংশ জমিই আমার সম্বল। এখান থেকেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়।
কামরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি আমার ক্ষেতের সীমানা ঘেঁষে পুকুর কাটায় জমির পাড় ভাঙতে শুরু করেছে। বিষয়টি কামরুজ্জামানকে জানালে তিনি পাত্তা দেননি।’
ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খননকারীদের মধ্যে আছেন বাবুল আক্তার, মনির মোল্যাসহ কয়েকজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নড়াইল-বেনাপোল সড়কে মাছিমদিয়া এলাকার মার্কেট নির্মাণ করা এক ব্যক্তি অতিরিক্ত লাভের আশায় পাকা স্থাপনা তৈরির কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি মোটামুটি ভালোভাবে ভবনটি নির্মাণ করেছেন! কেউ কেউ আরও বেশি লাভের আশায় চিকন রড দিয়ে দ্বিতল ভবন তৈরি করেছেন, যা জোরে বাতাস হলেও ধসে পড়তে পারে।
একাধিক বাড়ি নির্মাণকারী কামরুজ্জামান বলেন, ‘এখানে গরুর খামার করব। এ জন্য ঘর তৈরি করছি। এই জায়গার ওপর দিয়ে সড়ক যাবে কিনা, জানি না। এখানে মোকাম্মেলসহ আরও ৮-১০ জন বাড়ি বানাচ্ছেন।’ প্রায় একই উত্তর দেন কয়েক দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি ক্রয়কারী শফি মোল্যা। তিনি বলেন, ‘এখানে হাঁস ও গরুর খামার করব। এ জন্য জমিগুলো কিনেছি।’
মাছিমদিয়া গ্রামের জাকার মোল্লা জানান, সম্ভাব্য সড়কের ম্যাপ হাতে পেয়েছে একটি সিন্ডিকেট। তারা সে অনুযায়ী জমিগুলো বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনে নিচ্ছে। অনেককে ক্ষেতখামার বিক্রি করতে বাধ্য করছে। এসব জমিতে ডিসি ও এসপি অফিসেরও কেউ কেউ বাড়ি করছে। দালাল শফি মোল্লা এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। কুদ্দুস মোল্লা নামে এক নার্সারি ব্যবসায়ীও এ বিষয়ে অবগত। তিনিও জমির মালিকদের গাছ লাগানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। পরে সেই জমিগুলোর উচ্চমূল্য আদায় করে দেবেন বলে লোভও দেখাচ্ছেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কুদ্দুস বলেন, এর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
নড়াইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ধোপাখোলা থেকে সীতারামপুর পর্যন্ত তিন কিলোমিটার বাইপাস সড়কটির জন্য সম্পূর্ণ জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। কাজটি করবে জেলা প্রশাসন। আর ম্যাপটি পাস করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ঢাকা অফিসের। কীভাবে সেটি এই সিন্ডিকেটের হাতে এসেছে, তা তিনি জানেন না।
নড়াইল জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরী বলেন, মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে কোনো প্রস্তাব এখনও দেয়া হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ফসলি জমি নষ্ট করে স্থাপনা নির্মাণের খবর পেয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।