বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ভবন নির্মাণের সময় চারপাশে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছাড়ার নিয়ম থাকলেও সেটি মানা হয়নি। সামনের সড়ক ঘেঁষে বিল্ডিংটি নির্মাণ করা হয়েছে। নকশায় ৬ তলার অনুমোদন থাকলেও সাত তলার নির্মাণ চলছে; ইতিমধ্যে অর্ধেক নির্মাণ সম্পন্নও হয়েছে। চারপাশ জাল দিয়ে ঢেকে ও নিরাপত্তা-মাচা তৈরি করে ভবন নির্মাণের বিধানও থাকলেও কখনো সেটি করা হয়নি। যশোর শহরের পোস্ট অফিস পাড়ার মুন্সী মিনহাজউদ্দীন সড়কের ওই ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে পদে পদে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। তবে শুধুমাত্র ওই ভবনটিই নয়; শহর জুড়েই দৃশ্য এরকমই।
অভিযোগ উঠেছে, নিয়ম লঙ্ঘন করে এভাবে ভবন নির্মাণের ব্যাপারে অভিযোগ করা হলেও কোনো ধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছে না যশোর পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে অনুমোদনবিহীন চলছে ভবনের উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও চারপাশে একটুও জায়গা না ছেড়ে নির্মাণ কাজ। সেই সঙ্গে চলছে আশপাশের বাসিন্দা ও পথচারীদের জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনি তেরির নিয়ম উপেক্ষা। জবাদিহিতা ও শাস্তির মুখোমুখি হতে না হওয়ায় নির্বিঘ্নে চলছে এই নিয়ম লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, নিয়মানুযায়ী চারপাশে জায়গা না ছেড়ে নির্মিত ও নকশা বর্হিভূত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা ভবনগুলোর তালিকা তেরি চলছে। ক্রমান্বয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে নিয়মামাফিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো নজির এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কিম্বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কোনো দৃষ্টান্ত পৌর কর্তৃপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যশোর পৌরসভার একটি সূত্র জানায়, চারপাশে জমি ছাড়ার ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন, নকশা বর্হিভূত ভবন নির্মাণ ও ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রাসরণের বিষয়ে প্রতিনিয়ত পৌরসভায় লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ আসে। এসব অভিযোগের সংখ্যা অনেক। শত শত অভিযোগ ফাইল চাপা পড়ে আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। অবৈধভাবে নির্মিত এসব ভবন ভেঙে অপসারণের নিয়ম থাকলেও তেমনটি করা হয় না কখনো। উল্টোÑআর্থিক সুবিধার বিনিময়ে নিয়মবর্হিভূত নকশারও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে অহরহ। এক্ষেত্রে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নেয়া হচ্ছে। একটি সিন্ডিকেট নকশা অনুমোদনে টাকা নিচ্ছে। ‘সার্ভের’ দায়িত্বে থাকারা নিয়ম বহির্ভুতভাবে নির্মিত এসব ভবন চিহ্নিতের বদলে তথ্য আড়াল করছে।
নিয়ম লঙ্ঘন করে যশোর শহরের পোস্ট অফিস পাড়ার মুন্সী মিনহাজউদ্দীন সড়কে নির্মিত ভবনটির মালিক মাহফুজ্জামান মুক্তি। তিনি যশোর সদরের কচুয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা। ২০২২ সালের মাঝামাঝি তিনি ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। শুরু থেকেই নিয়ম লঙ্ঘন করলেও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি যশোর পৌর কর্তৃপক্ষ।
যশোর পৌরসভার নকশাকার সুমন আহমেদ জানান, পোস্ট অফিস পাড়ার মুন্সী মিনহাজউদ্দীন সড়কে মাহফুজ্জামান মুক্তি ৬ তলা বাড়ি নির্মাণের জন্য প্লান পাস করিয়েছেন। অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী তিনি ৬ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করতে পারবেন।
ভবন নির্মাণে মাহফুজ্জামান মুক্তি নিয়ম লঙ্ঘন করায় ক্ষতিগ্রস্ত পাশর্^বর্তী বাড়ির মালিক পৌরসভায় দুই দফায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। কেশবপুর সরকারি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহকারী অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামানের দাবি, পৌরসভায় অভিযোগ করেও কোনো সুরাহা হয়নি। নিয়ম না মেনে পাশের জমির মালিক ভবন নির্মাণ চালিয়ে গেছেন। তিনি জানান, ২০২২ সালের ২৭ জুন পৌরসভায় তিনি একটি লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর চলতি বছরের ৩০ জুন আবারো আরেকটি অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো ধরণের পদক্ষেপ নেয়নি।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, পাশের জমির মালিক মাহফুজ্জামান মুক্তি ভবন নির্মাণের সময় চারপাশে একটুও জমি ছাড়েনি। যখন ওই বাড়িটির পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয় তখন আমার বাড়িটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝাঁকুনিতে আমার বাড়ির সেপটিক ট্যাংকির পাইপ খুলে ভেঙে গিয়েছিল। আমার বাড়িতে অনেক ফাঁটল সৃষ্টি হয় তখন। এতে আমার অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
যশোর পৌরসভার প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে চারপাশে জায়গা ছাড়ার ক্ষেত্রে পৌরসভার আইনে সুষ্পষ্ট কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে ন্যশানাল বিল্ডিং কোডÑ১৯৯৬ এ বর্ণিত বিধি বিধান প্রযোজ্য। ওই কোডে বলা আছে, বাড়ি নির্মাণের সময় চারপাশে জায়গা ছাড়ার বিষয়টি নির্ভর করবে জমির পরিমাণের ওপর। ২ কাঠার কম পরিমাণ জমির ক্ষেত্রে ভবনের দুই পাশে ২ ফুট আট ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে হবে। এর চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি হলে দুই পাশে ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে বাড়ি নির্মাণ করতে হবে। আর জমির পরিমাণ যেটুকুই হোক না কেনো; নিয়মমাফিক সামনে ৫ ফুট জায়গা ফাঁকা রেখে ভবন নির্মাণ করতে হবে।
পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ সুুলতানা সাজিয়া জানান, ‘নকশার অনুমোদনবিহীন ও নকশা বর্হিভূত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা ভবন চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত চলছে। বিধি মোতাবেক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ধরণের ভবনের সংখ্যা কত সংখ্যক এমন প্রশ্নে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জানবেন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।’
যশোর পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম শরীফ হাসান জানান, ‘অনুমোদিত নকশার বাইরে যেসব ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে; সেসব ভবনের মালিকদের তাদের লোড ক্যাপাসিটি ক্যালকুলেশন করে পৌরসভায় অবহিত করতে বলা হয়েছে। পর্যবেক্ষণ করে যদি দেখা যায় লোড ক্যাপাসিটির চেয়ে বেশি তাহলে সম্প্রসারিত অংশ ভেঙে ফেলতে হবে। এগুলোর অনুমোদন দেয়ার কোনা সুযোগ নেই। প্লান অ্যাপ্রুভাল কমিটি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়।’