বাংলার ভোর প্রতিবেদক:
শখের বসে কাপড়ে নকশি তোলার কাজ শিখেছিলেন। কে জানতো এটিই তার উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠবে। যে নারী কয়েক বছর আগেও ঘরের বাইরে বের হতেন না, সংসার ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগানো নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখেছিলেন, সেই নারী এক দশকে হয়ে উঠলেন উদ্যোক্তা, ঘুরছেন দেশ-বিদেশে। যার মাসে আয় ২০-২৫ লাখ টাকা। জীবন-সংগ্রামের এই গল্পটা যশোর শহরের সার্কিট হাউজপাড়া এলাকার সালমা ইসলামের। শুধু সালমা ইসলাম নয়, ডিজিটাল জেলা যশোরে এমন লড়াকু যোদ্ধা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সহস্রাধিক জন। যারা নানা ঘাত-প্রতিঘাত জয় করেছেন, সমাজের বাধা-বিপত্তি ঠেলে জ্বালিয়েছেন জয়ের মশাল।
যশোরে নারীর জয়যাত্রা এখন সর্বত্রই। নারী তার আপন মেধা-যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। এক কালের ‘অবরোধবাসিনী’ নারীর এখন ঘরে-বাইরে জয়জয়কার। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীও বদলে গেছে নারীর প্রতি। গৃহে এবং বহিরাঙ্গনে দুই জায়গাতেই তারা ‘দশভূজা’ হয়ে উঠেছেন। জীবনের সব রঙ আর কর্মচাঞ্চল্যতা দিয়ে কর্মজীবী নারী সাজাচ্ছে তার জীবন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের যশোরের পরিসংখ্যান জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য মতে জেলার মোট জনসংখ্যা ৩০ লাখ ৭৬ হাজার ১৪৪ জন। যার মধ্যে পুরুষ ১৫ হাজার ২৪ হাজার ৩৪৯ জন এবং নারী ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৭ জন। জেলায় স্বাক্ষরতার হার পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে এ হার যথাক্রমে ৭৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ ও ৭৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত ৩৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারির তথ্য থেকে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ স্বাক্ষরতা বেড়েছে। স্বাক্ষরতার বৃদ্ধির সঙ্গে নারীরা কর্মক্ষমও বেড়েছে। ৩৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ নারী গৃহস্থালী কাজের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসা চাকুরির সঙ্গে নিয়োজিত।
নারী উন্নয়নে কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তারা :
যশোরে নারীদের উন্নয়নে কাজ করছেন নারী উদ্যোক্তারা। বঞ্চিত ও উদ্যমী নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার পথ দেখাচ্ছে জয়তী সোসাইটি ও বাঁচতে শেখা নামে দুটি সংস্থা। বর্তমান জয়তী সোসাইটিতে সদস্য সংখ্যা ২৮ হাজার। তারা সবাই নারী। এসব নারীর মধ্যে ১ হাজার ৮০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে জয়তী সোসাইটিতে। জয়তী সোসাইটির মোট কর্মীর ৯৮ শতাংশই নারী। পুরুষ কর্মী মাত্র ২ শতাংশ।
জয়তীর ব্যবসা সামলান নারীরা:
যশোরের রেলগেট মুজিব সড়কে সাড়ে সাত কাঠা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘জয়তী ভবন’। ভবনটিতে রয়েছে জয়তী হেঁশেল (বাংলা রেস্টুরেন্ট), জয়তী ফাস্ট ফুড, জয়তী চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, জয়তী পিৎজা ট্রি, জয়তী বিউটি পারলার, জয়তী ফিটনেস সেন্টার, জয়তী কনফারেন্স রুম (৫টি), জয়তী কমিউনিটি সেন্টার, জয়তী কারাতে সেন্টার (নারী ও শিশুদের জন্য), জয়তী গেস্টহাউস, জয়তী স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র, জয়তী বডি ম্যাসাজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
জয়তীর হেঁশেলটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে গোলাপি রং। এখানে ৮ থেকে ১০ জন নারী খাবার পরিবেশন করেন। তাদের পরনে গোলাপি পোশাক। হেঁশেলের ক্যাশ টেবিল সামলান নারী কর্মী। যে কেউ এই হেঁশেলে খেতে পারেন। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বিউটি পারলার। এখানে কাজ করেন নারী কর্মীরা। পারলারের পাশেই নারীদের ফিটনেস সেন্টার বা ব্যায়ামাগার। ফিটনেস সেন্টার তিন শিফটে চালু থাকে। একেক শিফটে ২৫ থেকে ৩০ জন নারী একসঙ্গে ব্যায়াম করতে পারেন। অন্যদিকে নারী আত্মউন্নয়নে কাজকেরছেন নারীদের সংগঠন বাঁচতে শেখা। প্রায় ১৫ হাজার সদস্য রয়েছে তাদের। সবাই আত্মকর্মসংস্থানের সঙ্গে জ্বালিয়েছেন জয়ের মশাল।
নারীদের নিয়ে কাজ করা অর্চনা বিশ্বাস বলেন, ‘যেভাবে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, সেভাবে নারীদের উন্নয়ন হয়নি। মূলত পারিবারিকভাবে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। যদিও আগের চেয়ে সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।’
১০ হাজার নারী উদ্যোক্তা
বর্তমানে যশোর জেলায় অন্তত ১০ হাজার নকশি উদ্যোক্তা রয়েছেন। যাদের প্রায় ১০০% নারী উদ্যোক্তা, এরমধ্যে অনেকেই বিধবা-ডিভোর্সি নারী। বর্তমানে যশোরে কম করে হলেও বছরে ৫ লাখ পিস নকশি কাঁথা উৎপাদন হয়।
যশোর পৌরসভার পূর্ববারান্দীপাড়া এলাকার এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের জননী শান্তা বেগম (৩৫)। স্বামী নাসির উদ্দীন স্বল্প বেতনে একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মরত আছেন। অর্থকষ্টে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় তাদের। এ অবস্থায় শান্তা বেগম সাংসারিক কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য নতুন পথ খুঁজতে থাকেন। একসময় এলাকার অন্য নারীদের কাছ থেকে শিখে নেন সুই আর সুতার কাজ। জীবন-জীবিকার তাগিদে স্বামী-সন্তানদের কথা চিন্তা করে ইচ্ছাশক্তি আর সুই-সুতার বুননের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এখন স্বাবলম্বী তিনি। শুধু শান্তা বেগমই নন, সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা আনতে যশোরের নারীরা সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে নকশিকাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলছেন নানা রঙের ফুল, পাখি, লতা, পাতাসহ বিভিন্ন কারুকাজ। এভাবেই সুই আর সুতার বুননে ভাগ্যের চাকা ঘোরাচ্ছেন যশোরের নারীরা। পরিবার সামলিয়ে অবসরে নকশিকাঁথাসহ বিভিন্ন ধরনের সেলাইয়ের কাজ করে অনেকে মুক্তি পেয়েছেন দারিদ্র্যের হাত থেকে।
যশোরের প্রথম নারী শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মর্জিনা আক্তার :
দেশ যতই এগিয়ে চলেছে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়নকাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। সেই সুযোগের শুরু হয় শিক্ষা থেকে। খুলনা বিভাগরে ১০ জেলার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যিনি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি একজন নারী। দেশের প্রথম ও যশোর বোর্ডের প্রথম নারী চেয়ারম্যান হলেন বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর মর্জিনা আক্তার।
প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে যশোরের সড়কে বেড়েছে লেডি বাইকার :
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সব জেলার নারীরা। সমাজের নেতিবাচক কথা ও প্রতিকূল পরিবেশকে হার মানিয়ে যশোরের সড়কেও রঙ-বেরঙের স্কুটি ও বাইক নিয়ে ছুটে চলছেন নারীরা। বাইক চালাচ্ছেন কেউ শখের বসে কেউবা আবার প্রয়োজনে। এসব স্কুটি ও বাইকার নারীদের মধ্যে অধিকাংশই কর্মজীবী। অর্থ ও সময় সাশ্রয়ী এবং ভোগান্তিহীন যাতায়াত মাধ্যম হওয়ায় নারীদের মাঝে বাইক বা স্কুটির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
যশোরের ষষ্ঠীতলা এলাকার বর্ণালী সরকারও একজন বাইকার। তিনি পেশায় চাকরিজীবী। অফিসে যাতায়াত করতে স্কুটি চালাচ্ছেন তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে। স্কুটি থাকায় অফিসে যাতায়াতের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে তার জন্য। বর্ণালী বলেন, পরিবার থেকে সাপোর্ট পেয়েছি। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসছে। নারীদের সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নারীদের পদচারণা বাড়ছে:
গৃহে এবং বহিরাঙ্গনের মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত যশোরে নারীদের পদচারণা দিন দিন বাঁড়ছে। এক সময়ে এ অঙ্গনে ধর্মীয় অনুশানের বেড়াজালে ঘর থেকে বের হতেন না। এখন অনেকেই নারীই অভিনয়, আবৃত্তি-দুটোই সমান গতিতে চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদেরই একজন শহরের পরিচিত মুখ রুহিনা শারমিন। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তর শেষ করে এই নারী চাকুরি করছেন বেসরকারি একটি এনজিওতে। এর পাশাপাশি তিনি তার এই প্রতিভা দিয়ে যেমন বন্ধুমহলে আলোচিত, তেমনই জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।
প্রায় দেড় দশক ধরে নাট্য অঙ্গনে কাজ করছেন সাবিকুন্নাহার কাকলী। পরিবার ও সংসার সামলানোর সঙ্গে নিজের প্রতিভা জানান দিয়ে কাকলী যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত পেয়েছে। মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মঞ্চেও উঠেছেন। মফস্বল শহরে মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। কাকলীর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি বলেন, ‘পরিবারের চেয়ে সমাজের লোকজনের বেশি আপত্তি। একদিকে ধমীয় জায়গা, সামাজিক ও পারিবারিক বাঁধার কারণে। অনেকেই মনে করে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হলে নারীরা খারাপ হয়। বিভিন্ন স্থানে যোগ দিতে হয়, ফলে নারীদের বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয়। যশোরের নারীদের সাংস্কৃতিক চর্চ্চা বাড়ছে। পদচারণা বেড়েছে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়া। তবে বাঁধাও আছে। তবে সেই সব বাঁধা ভেঙ্গে নারীরা এখন সবক্ষেত্রেই অগ্রসর হচ্ছে