প্রতীক চৌধুরী
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল দলের ত্যাগী ও সৎ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৭ সালে জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়। জিলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদটি যেন তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক জীবনে ‘আলাদিনের চেরাগ’ হয়ে ধরা দেয়। সাত বছর জিলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বসে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা। জিলা পরিষদের মালিকানাধীন সড়ক-মহাসড়কের গাছ বিক্রি, বরাদ্দ প্রকল্পের টাকা লুটপাট, নিয়োগ বাণিজ্য, জমি ইজারা ও দোকান বরাদ্দের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন। জিলা পরিষদে গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব সিণ্ডিকেট। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে দেদারসে জিলা পরিষদের মালিকানাধীন সড়কের গাছ ‘পানির দরে’ বিক্রি করায় ‘গাছ খেকো পিকুল’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান সাইফুজ্জামান পিকুল। জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করায় তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। সাবেক জিলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা যান যশোর জিলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ হাদিউজ্জামান। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল। জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও সৎ নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর বদলে যায় তার রূপ। শুরু করেন নিজের আখের গোছানোর মিশন। ২০২২ সালের ১৭ অক্টোর দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাইফুজ্জামান পিকুল। দুই দফায় প্রায় সাড়ে ৭ বছর তিনি জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে তিনি জিলা পরিষদের গড়ে তোলেন নিজস্ব সিণ্ডিকেট। সেই সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন টেণ্ডার বাণিজ্য, দোকান বরাদ্দ, নিয়োগ, প্রকল্পের লুটপাট। সর্বশেষ কয়েক বছর ধরে সাইফুজ্জামান পিকুলের সঙ্গে লুটপাটে যোগ দেন ছেলে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজীব নওশাদ পল্লব। বাবা-ছেলে চালাতেন লুটপাটের সিণ্ডিকেট। সে সময় তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পাননি কেউ।
একাধিক সাবেক জিলা পরিষদ সদস্য জানান, সাইফুজ্জামান পিকুল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অবৈধভাবে টাকা কামাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। জিলা পরিষদের প্রকল্প বরাদ্দে তাকে দিত হত ২৫ শতাংশ কমিশন। তিনি ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করেছেন। বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল নির্মাণ প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও তিনি জিলা পরিষদ থেকে একাধিকবার বরাদ্দ করে লুটপাট করেছেন। একই সাথে প্রতি বছর শীতবস্ত্র বিতরণ, দরিদ্রদের ঈদ সামগ্রি বিতরণ ও দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তার বরাদ্দের সিংহভাগ আত্মসাত করেছেন। জিলা পরিষদের মালিকানাধীন যশোর শহরের খাজুরা বাসস্ট্যাণ্ড ও যশোর টাউন মাঠ সংলগ্ন মার্কেটের দোকান বরাদ্দের নামে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেছেন সাইফুজ্জামান পিকুল। গাছ বিক্রি, দোকান বরাদ্দ, ভুয়া প্রকল্প, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার সহযোগী ছিলেন জিলা পরিষদের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিলেও প্রকৃত সম্পদের বিবরণী সব সময় গোপন করেছেন সাইফুজ্জামান পিকুল।
২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর জিলা পরিষদ নির্বাচনের হলফনামার সম্পদের বিবরণী বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৫ বছরে সাইফুজ্জামান পিকুলের বিপুলের সম্পদ বেড়েছে চার গুণ। নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানরাও বিপুল সম্পদের মালিক। ২০২২ সালে পিকুলের বাৎসরিক আয় ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে যা ছিল চার লাখ টাকা। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তার স্ত্রীর কোনো বার্ষিক আয় না দিলেও ২০২২ সালে তার স্ত্রীর বার্ষিক আয় এক লাখ দুই হাজার ৫০০ টাকা দেখানো হয়। ২০২২ সালে অস্থাবর সম্পদ ছিল নগদ ৬৬ লাখ ৮১ হাজার ৭৭ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা এক লাখ ৯৯ হাজার ৯৭৫ টাকা, বণ্ডঋণপত্র ইত্যাদি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সোনা ১০ তোলা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ৫০ হাজার, আসবাবপত্র দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা, যা বিগত নির্বাচনের (২০১৭ সাল) হলফনামার তুলনায় অনুযায়ী দ্বিগুণ।
২০১৭ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ না থাকলেও ২০২২ সালে ছিল নগদ দুই লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৭৩ হাজার ৫০৭ টাকা, বণ্ডঋণপত্র ইত্যাদি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্বর্ণ ১০ তোলা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ২০ হাজার ও আসবাবপত্র ১৫ হাজার টাকা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজ নামে এক হাজার ৮০৭ শতক জলকর জমি ও অকৃষি দশমিকশূন্য ৮ শতক।
একইভাবে স্থাবর সম্পদের বিবরণীতে ২০১৭ সালের হলফনামায় না থাকলেও ২০২২ সাইফুজ্জামান পিকুলের স্ত্রীর ৩ একর জলকর (জমি), অকৃষি জমি ১০ দশমিক ৭৫ শতক ও তিনতলা বসতবাড়ি দেখানো হয়েছে। আর নির্ভরশীলদের নামে একটি দেড়শ সিসি মোটরসাইকেল ও চার দশমিকশূন্য ৮ একর কৃষি জমি রয়েছে। তবে ২০২২ সালে কোনো দায়-দেনা না থাকলেও ২০১৭ সালের হলফনামায় মাছ চাষ বাবদ ২৪ লাখ টাকা দেনা উল্লেখ করেছিলেন পিকুল। ওই সময় সাইফুজ্জামান পিকুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার সম্পদ বাড়েনি। টাকার মান কমে যাওয়ায় এবং আমার মূল পেশা মাছচাষে উৎপাদিত পণ্যের (মাছের) দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় টাকার পরিমাণ বেড়েছে। আর ব্যবসায় কিছু উন্নতি হয়েছে।’
এদিকে, জিলা পরিষদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সড়কের গাছ দেদারসে বিক্রি করায় ‘গাছ খেকো পিকুল’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন সাইফুজ্জামান পিকুল। পরিবেশবাদী ও সচেতন যশোরবাসীর আপত্তি উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থে পানির দরে বিক্রি করেছেন মূল্যবান গাছ। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে বিক্রি ও আত্মসাত করায় পরিবেশবাদীরা ক্ষুব্ধ হন। যশোর-খুলনা মহাসড়ক, যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়ক ও যশোর-নড়াইল মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কের হাজার হাজার গাছ বিক্রির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন পিকুল সিণ্ডিকেট।
জিলা পরিষদের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে তাদের মালিকানাধীন চারটি সড়ক-মহাসড়কের ৪ হাজার ২১০টি গাছ কাটা হয়েছে। যার দাম প্রায় ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে যশোর-খুলনা মহাসড়কে ১ হাজার ৮৯৫টি, ২০২১ সালে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর সেতু এলাকা থেকে ১২টি গাছ কাটা হয়। এর পরও যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক থেকে নানা সময়ে কাটা পড়েছে আরও ৮৩৫টি গাছ। ২০২২ সালে যশোর-চুকনগর মহাসড়কে ৫০৭টি গাছ কাটা হয়। ২০২৪ সালের মে মাসে যশোর-নড়াইল সড়কে ৯৬১টি গাছ কাটার টেণ্ডার দেয়া হয়। যার দাম ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞায় যশোর-নড়াইল সড়কের গাছ কাটা বন্ধ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর যশোর-খুলনা মহাসড়কের শেষ সীমানা পর্যন্ত ৪ গ্রুপ ও যশোর ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর ব্রীজ পর্যন্ত এক গ্রুপ সর্বমোট ৫ গ্রুপে এক জাহার ৯৬২টি শতবর্ষী মেহগনী ও রেইন্ট্রি গাছ টেণ্ডার করে জেলা পরিষদ। সেই সময় নামে বেনামে এই ৫ গ্রুপের টেণ্ডারই বাগিয়ে নেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার ছেলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিব নওশাদ পল্লব। প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের গাছ বেনামী প্রতিষ্ঠানের নামে সাড়ে ৫ কোটি টাকার মূল্যে কিনে নেন সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার ছেলে। একইভাবে যশোর-নড়াইল ও যশোর- চুকনগর সড়কের গাছের টেণ্ডারও নিজেদের নামে বেনামে ক্রয় করেন বাবা-ছেলে। নিজ ক্ষমতাবলে সরকারি টেণ্ডারের টাকা জেলা পরিষদের হিসাবে জমা না দিয়েই বের করে নেন কার্যাদেশ। এর পর ওই কার্যাদেশের ৩৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন মেসার্স বাবলু এন্ট্রারপ্রাইজসহ একাধিক ঠিকাদারের কাছে।
যশোর-বেনাপোলসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের গাছও লুটপাট হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ মাসে তৃতীয় দফায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তার পছন্দের স্টাফ সার্ভেয়ার আল-আমিনকে কাজে লাগিয়ে শার্শা-গোগা সড়ক, শার্শা-গোড়পাড়া সড়ক, ঝিকরগাছা-বাকড়া সড়ক, ঝিকরগাছা-কায়েমকোলা সড়ক, চৌগাছা-মহেশপুর সড়ক, চৌগাছা-কোটচাঁদপুর সড়ক, চৌগাছা-যশোর সড়ক, পুলেরহাট-ত্রিমোহিনী সড়ক, সদর উপজেলার হৈবতপুর-পরানপুর সড়ক ও শার্শার গোড়পাড়া-ব্যাঙদা সড়কের ৫০৯টি রেইন্ট্রি ও মেহগণী গাছ বিক্রির দরপত্র আহবান করে। গত ২৯ এপ্রিল এই টেণ্ডারের কার্যাদেশ দেন দুই গ্রুপে ভাগ করে। এক নম্বর গ্রুপে মেসার্স মিলন এন্টারপ্রাইজের নামে ১৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকা মূল্যে ২৫৬টি জীবিত গাছ বিক্রি করা হয়। আর মেসার্স জাহান এন্টারপ্রাইজের নামে দুই নম্বর গ্রুপে মৃত ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ২৫১ টি গাছ ভ্যাট আইটিসহ ৫ লাখ ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। তবে ওই প্রতিষ্ঠান দুটির স্বত্ত্বাধিকারীরা দাবি করেছেন, টেণ্ডারের বিষয়ে কিছুই জানেন না তারা। জেলা পরিষদ কবে, কখন, কোথায়, কিসের টেণ্ডার দিয়েছে বা কি কাজের কার্যাদেশ দিয়েছে তা জানা নেই। এভাবেই নামে-বেনামে লুটপাট চালিয়েছেন সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার সহযোগিরা।