বাংলা ভোর প্রতিবেদক
কেউ নিয়ে আসছেন শর্টগান, কেউবা পিস্তল, আবার কেউবা রিভলভার নিয়ে আসছেন থানায়। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে নিজ নিজ থানায় লাইসেন্সধারী অস্ত্র জমা না দিলে নেয়া হবে কঠোর আইননানুগ ব্যবস্থা। তাইতো যশোর কোতয়ালী মডেল থানাতে দিনভর যার যার অস্ত্র নিয়ে এভাবেই আনাগোনা ছিলো লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবহারকারীদের। আর যারা স্বশরীরে আসতে পারেননি; প্রতিনিধি মারফতে দিয়েছেন অস্ত্র জমা। শুধু কোতয়ালী মডেল থানায় নয়; জেলার ৯ থানায় মঙ্গলবার দিনভর ছিলো অস্ত্র জমা দেয়ার হিড়িক। তবে জেলায় শর্টগান, পিস্তল, রিভলভার মিলে এক হাজার ১৩৮ লাইসেন্সধারী থাকলেও মঙ্গলবার রাত আটটা পর্যন্ত কতজন অস্ত্র জমা দিয়েছেন সেটা বলতে পারেনি জেলা প্রশাসন। তবে কয়েকজন নেতার অস্ত্র লুট হওয়ার ও আত্মগোপনে থাকাতে অস্ত্র জমা দেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বুধবার শুরু হচ্ছে যৌথ অভিযান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে মঙ্গলবারের মধ্যে ওইসব অস্ত্র জমা দিতে বলা হয়। এর মধ্যে জমা না দিলে ওইসব অস্ত্রও অবৈধ হয়ে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক নাগরিকদের দেয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। তবে এর আগে দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বহাল আছে। তাদের আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিতে হবে না।
যশোর জেলা প্রশাসকের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাখার তথ্যমতে, যশোরে এক হাজার ১৩৮ লাইসেন্সধারী রয়েছে। বেশিরভাগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধি। এছাড়া বিএনপির নেতাকর্মী ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। মোট লাইসেন্সধারীর মধ্যে রিভালবার ১০টি, পিস্তল ৩০টি, শর্টগান ৯৮টি, রাইফেল ৩২টি, একনলা বন্দুক ১৮৮টি, দুনলা বন্দুক ১৬৮টি রয়েছে।
মঙ্গলবার যশোর কোতয়ালি মডেল থানায় দিনভর যার যার অস্ত্র নিয়ে আনাগোনা ছিলো লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবহারকারীদের। আর যারা স্বশরীরে আসতে পারেনি; প্রতিনিধি মারফতে দিয়েছেন অস্ত্র জমা।
অস্ত্র জমা দেয়া কয়েকজন জানান, ‘নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বৈধভাবেই অস্ত্র ক্রয় করে লাইসেন্সে গ্রহণ করি। এখন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অস্ত্র জমা দিতে এসেছি। পরবর্তীতে আবার অস্ত্র লাইসেন্সে গ্রহণ করবো।
অস্ত্র জমা দিতে আসা আরেকজন বলেন, ‘আমরা এক বড়ভাইয়ের অস্ত্র জমা দিতে এসেছি। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী ও জনপ্রতিনিধি ছিলেন। এখন তিনি দেশের বাইরে। সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অস্ত্র জমা দিতে এসেছি।’
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কোতয়ালি মডেল থানায় ১৩৫টি লাইসেন্সধারী অস্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে কিছু সামরিক ব্যক্তিদের। আর বেশি রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে ৯৪টি জমা হয়েছে।’
এ বিষয়ে যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) কমলেশ মজুমদার বলেন, ‘অস্ত্র জমা দিতে হবে থানায়। আর যারা অথোরাইজড ডিলারের কাছে আগেই আগ্নেয়াস্ত্র জমা রেখেছেন তারা থানায় শুধু জমার কাগজপত্র জমা দিলেই হবে। অস্ত্র ও গুলি সবই জমা দিতে হবে। মঙ্গলবারের মধ্যে যারা জমা না দেবেন তাদের আগ্নেয়াস্ত্র অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। কিন্ত মঙ্গলবার জেলায় মোট কত অস্ত্র জমা দেয়া হয়েছে, সেটার তালিকা করা হয়নি। আজ টোটাল জানা যাবে।
বৈধ অস্ত্রের তথ্যভান্ডার ‘ফায়ার আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের’ (এফএএমএস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২১ সালে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ছিল ৪৪ হাজার ১০৪টি, যার মধ্যে ব্যক্তির নামে রয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৭টি অস্ত্র। বাকি অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল।
তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা এখন ৫০ হাজারের মতো। এর কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে। ১০ হাজার অস্ত্র আছে রাজনৈতিক নেতাদের নামে। এর মধ্যে এক ব্যক্তি একাধিক লাইসেন্সও নিয়েছেন। বৈধ অস্ত্রের হিসাব থাকলেও দেশে অবৈধ অস্ত্র কত আছে তার কোনো হিসাব নেই। পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে সারাদেশ থেকে প্রায় আট হাজার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় তিন হাজার অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলন দমাতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে সিভিল ড্রেসে অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. এম সাখাওয়াত হোসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পর বলেছিলেন, ‘এমন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রও ব্যবহার করা হয়েছে যা এদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নেই।’ আবার আন্দোলনের সময় থানায় হামলা ও আগ্নেয়াস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটেছে। শুধু ঢাকা শহরের থানাগুলো থেকেই এক হাজার ৮৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। তার মধ্যে এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৫৫৩টি আগ্নেয়াস্ত্র।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশ থেকে আন্দোলনের সময় থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গুলি লুট হয়েছে সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে এ পর্যন্ত সারাদেশ থেকে লুট হওয়া তিন হাজার ৩০৪টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই লাখ ৫১ হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঝিকরগাছা সংবাদদাতা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় যশোরের ঝিকরগাছা থানা সূত্রে জানা গেছে, ঝিকরগাছা থানায় ২৮ টি বৈধ আগ্নেয় অস্ত্রের মধ্যে ২৬ আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েছে। জমা পড়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ১০টি একনলা বন্দুক, ১০ টি শর্টগান, ৩ টি দোনালা বন্দুক এবং ৩ টি পিস্তল জমা পড়েছে। বাকি দুইটা আগ্নেয়াস্ত্র একটি সরকারি কর্মকর্তা এবং অপরটি জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার বলে জানা গেছে। পুলিশ প্রশাসন বলছেন, আশা করা যাচ্ছে তারা রাত বারোটার পূর্বেই জমা দিয়ে দেবেন। ঝিকরগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ কামাল হোসেন ভূঁইয়া জানান, ২৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ২৬ টি জমা পড়েছে। অবশিষ্ট দুইটি অস্ত্র নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই জমা হয়ে যাবে বলে আশা করছি।