# স্বর্ণের কানের দুলের লোভে খুন
# দুল বিক্রি করে রেস্টুরেন্টে খেতে যান খুনি
# অভিযুক্ত কারাগারে
হাসান আদিত্য
সাত বছরের শিশু সাদিয়া খাতুন। এলাকায় তার সমবয়সী অনেকেই থাকলেও একমাত্র খেলার সঙ্গী বিশ বছর বয়সী চম্পা খাতুন। সদিয়াদের দু’ বাড়ি পরেই চম্পার বাড়ি। সকাল কিংবা রাত সাদিয়ার অবাধ যাতায়াত ছিল সেই বাড়িতে। রক্তের কেউ না হলেও চম্পাকে প্রতিবেশী ফুফু বলেই সম্বোধন করতো শিশুটি। সাদিয়াকে পড়াশোনাও করাতো চম্পা। এমনও দিন গেছে চম্পার হাতে ভাত না খেলে কিছুই খায়নি চঞ্চল জেদী স্বভাবসূলভ শিশু সাদিয়া। দুজনের এমন মিলে এলাকার রোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে সাদিয়ার দ্বিতীয় মা চম্পা। প্রতিদিনের ন্যায় মঙ্গলবার দুপুরে চম্পার বাড়িতে খেলতে আসে সাদিয়া। মধ্যরাতে চম্পার বাড়ির পাশ থেকে গলায় গেঞ্জি পেঁচানো অবস্থায় সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
সাদিয়ার পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ দাবি করেছে, সাদিয়ার কানে থাকা সোনার দুলের লোভে চম্পাই তাকে শ্বাসরোধ করেছে। সোনার দুল হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশে চম্পা তাকে হত্যা করেন। পরে সেই দুল বিক্রি করে রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করেন। এর আগে শিশুটি ১৩ ঘণ্টা যাবত নিখোঁজ ছিলো। এদিন যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে সাদিয়ার মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সন্ধ্যায় পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এই হত্যার অভিযোগে চম্পা খাতুনকে আসামি করে মামলা করেছে শিশুটির পিতা। দুপুরে স্থানীয় বিক্ষুদ্ধ জনতা চম্পাকে আটক করে পুলিশে দেয়।
মারা যাওয়া সাদিয়া খাতুন ঝিকরগাছার মাটিকোমরা গ্রামের দক্ষিণপাড়ার বাবলুর রহমানের মেয়ে। সে স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসায় পড়ত। বাবলুর রহমান কৃষিকাজ করেন। এ ঘটনায় আটক চম্পা খাতুন (২২) মাটিকোমরা গ্রামের আনিসুর রহমানের মেয়ে। চার বছরের মেয়েকে নিয়ে চম্পা বাবার বাড়িতেই থাকেন। চম্পার বাবা আনিসুর মালয়েশিয়াপ্রবাসী। স্থানীয়রা জানান, অভিযুক্ত চম্পা মাদকাসক্ত। এর আগে ছোটখাটো চুরি করার ঘটনার সাথে জড়িত ছিল সে।
পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দুপুরের দিকে হঠাৎ নিখোঁজ হয় সাদিয়া। প্রতিবেশী চম্পাসহ আশপাশের বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করেও সাদিয়াকে পায়নি তার পরিবার। এরপর তাকে না পেয়ে সাদিয়ার বাবা বাবলুর রহমান ঝিকরগাছা থানায় অভিযোগ করেন। এ সময় তারা চম্পা খাতুনের ওপর তাদের সন্দেহের কথাও পুলিশকে জানান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চম্পার বাড়িতে গিয়ে তাকে আটক করে পুলিশ। তখন চম্পার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাড়ির পাশের একটি বাগান থেকে সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহত শিশুর দাদা ফজলুর রহমান জানান, মঙ্গলবার দুপুর থেকে সাদিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ঝিকরগাছা থানায় একটি জিডি করা হয়। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সাদিয়াকে তার প্রতিবেশি ফুফু চম্পার সঙ্গে দেখা গেছে।
সন্দেহজনক আসামি হিসেবে গ্রামবাসী চম্পাকে রাতেই ঝিকরগাছা থানায় সোপর্দ করে। এরপর রাত বারোটার দিকে বাড়ির পাশে একটা বাঁশ বাগান থেকে সাদিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এলাকায় চাঞ্চল্যকর ঘটনা হওয়াতে শুধু মাটিকুমরা গ্রামই নয়; হাজিরবাগ ইউনিয়ন জুড়েই ছিলো এই নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শোকের ছায়া। সেটির প্রমাণ সাদিয়ার জানাজা। বাড়ির পাশে একটি আম বাগানে প্রায় ৭ থেকে ৮ শ’ মানুষের অংশগ্রহণই প্রমাণ করে মানুষকে কতটা নাড়া দিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড।
বুধবার বিকেলে সাদিয়াদের বাড়িতে যেয়ে দেখা যায় দোচালা মাটির টালি দেয়া ছাউনি আর টিনের বেড়া দেয়া দুইটি কক্ষবিশিষ্ট বাড়ি। বাড়িতে প্রতিবেশি ও নারীরা সাদিয়ার মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। পুরুষ লোকেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়িটির দিতে তাকিয়ে অনেকে আফসোস করছিলেন আর সাদিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, সাদিয়ারা তিন ভাই-বোন। সাদিয়া সবার ছোট। তার উপরে ৮ ও ১২ বছর বয়সী দুই ভাই রয়েছে। দুই সন্তানের পরে একটি মেয়ে সন্তান হওয়ায় বড় আদরের ছিলো সাদিয়া। দুষ্টুমি আর আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে রাখতো পুরো বাড়িটি।
সাদিয়ার মা শাহানারা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমার বড় আদরের ছিলো সাদিয়া। আমার সাদিয়া কই। চম্পার সাথে মেয়েটার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিলো। চম্পার একটা মেয়ে আছে; আমার মেয়েটারেও সে মেয়ে হিসাবে মানতো। পড়াতো, খাওয়াতো, মাঝে মধ্যে ওর বাড়িতে থাকতো। নানান লোকে নানান কথা বললেও কখনো ভাবিনি, আমার মেয়েটারে ও এই দশা করবে। ওর (চম্পা) টাকা লাগতো, আমারে বলতো। যে করেই হোক টাকা ম্যানেজ করতাম। নাই দুলডাই নিয়ে নিতো। আমার মেয়েটারে ক্যান মারলো! আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন জানান, আটক চম্পা ইয়াবাসেবী বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন। তিনি শিশুটির কানে থাকা সোনার দুল হাতিয়ে নেয়ার লোভে তাকে হত্যা করেছেন বলে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
রেশমা শারমিন বলেন, ‘চম্পা শিশুটির কান থেকে দুল খুলে নিয়ে যশোর শহরে এসে একটি দোকানে তা বিক্রি করে। এরপর সেই টাকা দিয়ে শহরের জেনারেল হাসপাতালের সামনে ভৈরব হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করে।
ঝিকরগাছা থানার ওসি বাবলুর রহমান খান জানান, খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে তার বাবা থানায় অভিযোগ করেন। এ সময় তারা চম্পা খাতুনের ওপর তাদের সন্দেহের কথা জানান। গ্রেফতারের পর তার স্বীকারোক্তিতে বাড়ির পাশের হারুন অর রশিদের বাগান থেকে শিশু সাদিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার কনের স্বর্ণের দুল নিতে পরনের গেঞ্জি দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
ওসি আরও জানান, আটক চম্পা খাতুন প্যাথেড্রিনসহ নানা ধরনের মাদকসেবী বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে। এদিন বিকেলে পুলিশ চম্পাকে যশোর চিফ জুডিশিয়াল আদালতে পাঠালে বিচারক তাকে কারাগারে প্রেরণ করেছেন।