এইচ আর তুহিন
যশোর একটি অতি প্রাচীন জনপদ। ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত যশোর জেলার পুরাতন বিবরণ রয়েছে টলেমির মানচিত্রে। এছাড়াও মহাভারত পুরান ও বেদে’তে এ অঞ্চলের কথা উল্লেখ রয়েছে। বৃটিশ আমলে যশোর জেলার একটি মহাকুমা ছিলো। যশোর অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা। প্রাচীন সময় থেকেই শিক্ষা সংস্কৃতিতে যশোরের নাম সুপরিচিত ছিল দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে। উপমহাদেশে প্রথম যে চারটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে যশোর জিলা স্কুল একটি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভূমি যশোর। এখানে রয়েছে শতাব্দীর প্রাচীন পৌরসভা। স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবান্বিত ইতিহাস রয়েছে বৃহত্তম যশোরের। প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোর। এছাড়াও বৃহত্তর যশোরে দুই জন বীরশ্রেষ্ঠের জন্মস্থান। বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষ অবদান রাখছে জেলাটির। জেলার বেনাপোল স্থল বন্দর দিয়ে ভারতের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানির করা হয়। যশোরের গদখালি কে বলা হয় ফুলের রাজধানী। সবজি, মাছের রেণু, নকশী কাঁথা, খেজুরের রস, গুড়-পাটালিসহ নানা কারণে যশোর বিখ্যাত। এ জেলাতে কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, সুধিজন সবই আছে। কিন্তু নানা কারনে এ জেলার কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি!
কোন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান অনেক বেশি থাকে। কারণ সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র বিন্দু ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য কয়েক বছর আগে এখানে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৃহত্তর প্রাচীন একটি জেলা শহরে নবীন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ, ভাবতে বেশ আশাহত করে আমাদের। এরপর এখন মেডিকেল কলেজে কোনো হাসপাতাল নেই। যা ভাবতেই অবাক লাগে।
যশোরে বিমান প্রশিক্ষণ একাডেমি থাকলেও বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানের নয়। বৃহত্তর যশোরে দুই জনপ্রিয় খেলোয়ার সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি। চলচ্চিত্র জগতের সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, রিয়াজ সঙ্গীতাঙ্গনের মনির খান, প্রণব ঘোষ বৃহত্তর যশোরের মানুষ। সাংস্কৃতিক সংগঠন যশোরের উদীচী ও নাট্য সংগঠন বিববর্ত যশোর’র কথা সারা দেশের মানুষ জানে। দেশের বৃহত্তম সিনেমা হল এই যশোরেরই ‘মনিহার’ সিনেমা হল। ফলে সংস্কৃতি চর্চা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যশোর যে কোন অঞ্চলের থেকে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু কাঙ্খিত উন্নয়ন কি হয়েছে যশোরে? ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এ জেলা নিয়ে কেন সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিতে পারছিনা আমরা?
প্রথম ডিজিটাল জেলা, আইটি পার্ক প্রতিষ্টিত হলেও খুলনা বিভাগের একমাত্র বিমানবন্দর এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কেন এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো? কেন এখানে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি? যশোরকে বলা হয় ক্রিকেট ও সংস্কৃতি চর্চার উর্বর ভূমি কিন্তু এখানে নেই কোন আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম ও সিনেপ্লেক্স।
বৃহত্তর যশোরের মহেশপুর উপজেলায় রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম কৃষি খামার। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টিত হলেও কেন এখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে না? মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও লালন শাহের নামে সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় কবে হবে? কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইপিজেড তৈরি করা হলেও যশোরের এখনো পর্যন্ত ইপিজেড তৈরি হয়নি। কোন অঞ্চলের উন্নয়ন করতে হলে একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হয়। তবে কি আমাদের পরিকল্পনার অভাব রয়েছে?
বিভিন্ন সময় গঠিত সরকারে মন্ত্রী পরিষদে এ অঞ্চলের সংসদ সদস্যদের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে জাতীয় নেতাও নেই এখানে তেমন। ফলে উন্নয়নে খুব বেশি এগোতে পারছে না যশোর। যশোরে ইপিজেড তৈরি কথা চিন্তা রয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এর ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ অঞ্চলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে কৃষি ক্ষেত্রে নতুন নতুন গবেষণার দ্বার উন্মোচন করতে হবে। যার মাধ্যমে কৃষি সেক্টরের উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। মধুসূদন দত্ত ও লালন শাহের নামে যশোর ও ঝিনাইদহে দুইটি সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা সময়ের দাবি। যশোর মেডিকেল কলেজে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এবং একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে যশোরে।
যশোর অঞ্চলে সাংস্কৃতিক চর্চা ত্বরান্বিত করতে সিনেপ্লেক্স, নাট্যমঞ্চ ও ফিল্ম সিটি তৈরি করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, সংগীত, নৃত্য বিভাগ খুলতে হবে। এছাড়া ইসলামিক জ্ঞান চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আধুনিক ইসলামিক ইনস্টিটিউট চালু করতে হবে। এর ফলে সঠিক ধর্মের চর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটবে। যার মাধ্যমে উগ্রবাদ নির্মূল করা যাবে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার নাগরিক তৈরি করা সম্ভব হবে।
যশোরে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম ও বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে রূপান্তর করতে হবে। ফলে দেশ বিদেশের মানুষ সহজেই এ অঞ্চলে আসতে পারবে। এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে সুন্দরবন ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। যশোর পৌরসভাকে সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তর, বিভিন্ন গবেষণা ইনন্টিটিউট তৈরি, গ্যাস সরবরাহ, ঢাকা টু যশোর হয়ে খুলনা এবং বেনাপোলের মধ্যে রেলের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পকারখানা তৈরি করে বৃহত্তর যশোরের উন্নয়ন সম্ভব।
সড়ক ও রেল পথে যশোরের সাথে রাজধানী শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। যশোরের সাথে পার্শ্ববর্তী জেলা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরের রেল ও সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যশোরকে একটি আধুনিক এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিবান্ধব শহরে পরিণত করা সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক ও সংগঠক