বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর শহরের ভৈরব পাড়ের দু’কিলোমিটারের মধ্যে ভয়াবহ নদী ধসে অন্তত ৮০টি পরিবারের বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে। নদ থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ। জমি-বাড়ি ধসে এই পরিবারগুলোর অন্তত আট কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় তিন আগে এই নদী ভাঙ্গনের ঘটনা শুরু হয়। কিন্তু নদীর তীর রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগে, ভৈরব খননের প্রকল্প চলাকালে প্রভাবশালী একটি মহল একাধিক ড্রেজিং মেশিন দিয়ে কয়েক বছর ধরে বালু উত্তোলন করে তাদের এমন বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বালু উত্তোলনের কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিনা তাদের জানা নেই। নদী গর্ভে ‘গর্ত’ হবার কারণে মাটি সরে যাওয়ায় এ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০ সালের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শহরের কাজীপাড়া আব্দুল আজিজ সড়কের তেতুলতলা কালভার্টের নিকটবর্তী ভৈরব নদে ড্রেজিং মেশিন স্থাপন করে বালু উত্তোলন শুরু করে। দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করে এক কিলোমিটারেরও বেশি দূরে শহরের পুলিশলাইনের মধ্যবর্তী সরকারি পুকুর ভরাট শুরু করে। তখন থেকেই জনউদ্যোগ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এই বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে প্রেসমিট করে এবং প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেয়। প্রশাসন কথাও দেয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের। কিন্তু বালু উত্তোলন বন্ধের পরিবর্তে আরও বেশিমাত্রায় তোলা শুরু হয়। এমনকি পুলিশলাইনের কাজটি সম্পন্নের পর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে বালিখেকোদের। স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে ব্যাপকমাত্রায় বালু উত্তোলন শুরু হলে ভৈরবের বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া, রায়পাড়া ও বাবলাতলা এলাকার ভৈরবপাড় জুড়ে ভূমিধস ও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। স্রোতবিহীন নদের দু’পশে ছোটবড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে; দেবে যাচ্ছে নদের পাড়। ভৈরব পাড়ের এই দু’কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৮০টি পরিবার ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। তাদের অন্তত ৮ কোটি টাকার জমি-বাড়ি ঘর গাছপালা নদীর গ্রাসে চলে গেছে।
ভৈরব নদের বাবলাতলা ব্রিজের পাশে ধার-দেনা করে ২০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ি করেছিলেন প্রাইভেটকার চালক কেরামত আলী। গত অক্টোবর মাসে তার বাড়িটি ধসে পড়েছে। সোয়া ৮ শতক জমির সিংহভাগই নদীর পেটে চলে গেছে। শ্রমজীবী কেরামত আলী জানান, বাড়ি নির্মাণের সব লোন-বাকী এখনও শোধ হয়নি। ইটভাটায় বাকী, রড-সিমেন্টের দোকানে বাকী আর এনজিও’র লোন মিলে ৫ লাখ টাকা এখনও দেনা। এর মধ্যে বাড়ি ভেঙ্গে নদীতে চলে গেছে; যেটুকু টিকে আছে তার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি।
ভৈরব পাড়ের বাবলাতলা এলাকার বাসিন্দা চাকরিজীবী শরিফুল ইসলাম বলেন, নদী খননের সময় ঠিকাদারের মাটি কাটার কথা। কিন্তু তারা তারা মেশিন লাগিয়ে বছরের পর বছর বালি তুলেছে। এই বালি তোলায় গত বর্ষার পর থেকে নদীর পাড় ধসে পড়ছে। এর সাথে ঘরবাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে; ধসে পড়ছে। প্রায় দশ লাখ টাকা খরচ করে সাতমাস আগে তিনি বাড়ি করেছিলেন। সেই বাড়ি ভেঙ্গে গেছে।
পুরাতন কসবা রায়পাড়া এলাকার গৃহবধূ বেবী খাতুন জানান, তাদের বাড়ির দেওয়ালে হাল্কা ফাটল দেখা দিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনটি বেডরুম, ডাইনিং, ড্রইং ও বাথরুম পুরোটাই ধসে ভেঙে পড়ে। এছাড়া পুরাতন বাসার সাথেই নতুন ঘর তুলছিলেন, সেগুলোও ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।
প্রিয়াংকা অধিকারী বলেন, বৃষ্টিতে একটু একটু করে ফাটল ধরে। তারপর হঠাৎই ঘর মাটিতে দেবে যায়। দুই বছর ধরে নদী থেকে বালু তোলার কারণে এটা হয়েছে। সবাই জানলেও কেউই প্রকাশ্যে বালুখেকো জনপ্রতিনিধির নাম নিতে সাহস পাননি।
উপশহরের ভৈরব পাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আসাদুল ইসলাম বলেন, বাড়িঘর ধসে যাওয়ায় তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে নদের তীর রক্ষা ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। তারা পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
ভৈরবের বালি উত্তোলনের প্রতিবাদে সোচ্চার থাকা সংগঠন ‘জনউদ্যোগ, যশোরের’ আহ্বায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমেদ বলেন, নদী খাত থেকে বালু উত্তোলন গভীর, সুগভীর নাকি উপরিতল থেকে হবে, তার ভিত্তিতে বিপর্যয়ের মাত্রা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে। হঠাৎ করে কোনো স্থান পার্শ্ববর্তী স্থানের চেয়ে গভীর করে খনন করে বালু উত্তোলন করা হলে পার্শ্ববর্তী চতুর্দিকের মাটি বা ভূমি বছরের পর বছর ধরে ধসে যেতে থাকবে এবং এর প্রভাবে আশেপাশের স্থাপনা ও বসতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গভীরতা যত বেশি হবে, ধসের এলাকাও তত বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম বালি অধিক গভীর করে উত্তোলন করা হলে আশেপাশের অনেকদূর এলাকা ভূমিকম্পজনিত ব্যাপক ভূমিধসের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে প্রায় শত বছর লেগে যাবে। আবার যে মৃত্তিকার নিচে বালিস্তরের অভাব রয়েছে বা বেশি পুরু স্তরের অভাব রয়েছে সেখানে বহুতল ভবন বা অট্টালিকা নির্মাণ কষ্টকর, ব্যয়সাপেক্ষ ও স্থায়িত্ব বা টেকসই হবার ঝুঁকিতে থাকে। বহুতল ভবন যদি আগেই নির্মিত হয়ে থাকে তবে তার কাছাকাছি দূরত্বের মৃত্তিকার নিচের বালি উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্ত ক্রমান্বয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মাটি ধসে এসে ভরাট হতে থাকে এবং এভাবে আস্তে আস্তে বেশ দূর পর্যন্ত ধসের প্রভাব পড়তে পারে। অনেক বছর ধরে এ গর্ত পরিপূর্ণভাবে বন্ধ বা বুজে গেলেও তার উপর বহুতল ভবন নির্মাণ কষ্টসাধ্য হবে এবং টেকসই হবেনা। এমন আরও অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। ৪ বছর আগে আমাদের সতর্কবাণীকে আমলে নেয়া হয়নি বলেই আজকের এই বিপর্যয়।
তিনি উল্লেখ করেন, এই অঞ্চলের অন্তত ৮০টি পরিবার ঠিকাদার ও বালুখেকোদের অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এতে তাদের অন্তত ৮ কোটি টাকার জমি, বাড়িঘরসহ সহায় সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জিএম রাইসুল ইসলাম জানান, ভৈরবপাড়ের ধসে পড়া এলাকায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে জিও ব্যাগ দিয়ে পাড় রক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাড় রক্ষা ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এদিকে, ভৈরব নদ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করেছে জনউদ্যোগ যশোর। বাবলাতলা ভৈরব নদের পাড়ে জনউদ্যোগ যশোরের আহবায়ক প্রকৌশলী নাজির আহমদের সভাপতিত্বে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভৈরব নদ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন জনউদ্যোগ সদস্য বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র যশোর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা মাহবুবুর রহমান মজনু। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ, যুগ্ম আহবায়ক অধ্যাপক সুরাইয়া শরীফ, সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দা মাসুমা বেগম, আইইডি যশোর কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক বীথিকা সরকার, সদস্য সচিব কিশোর কুমার কাজল প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন থেকে জনউদ্যোগ যশোর ভৈরব নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি এবং ভৈরব নদ থেকে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।