স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার বাজার যশোরের রাজারহাটে ঈদপরবর্তী সময়ে চামড়ার বাজারে চরম মন্দা দেখা দিয়েছে। সরকার নির্ধারিত ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ফুটের পরিবর্তে ২৫ থেকে ৩০ টাকা ফুট দরে বিক্রি হচ্ছে গরু ও মহিষের চামড়া। যার ফলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ছেন খুচরা বিক্রেতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারা এই অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাসের পেছনে সিন্ডিকেট এবং বাইরের বড় ব্যবসায়ীদের অনুপস্থিতিকে প্রধান কারণ হিসেবে ধারণা করছেন।
যশোরের রাজারহাটে দীর্ঘ বছর ধরে চামড়ার বাজার বসে আসছে। এই বাজারে সারা বছর কম বেশি চামড়া বেচাকেনা হলেও পশু কুরবানির পর সাধারণ চামড়ার আমদানি বাড়ে। যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, নড়াইলসহ দক্ষিণ পশ্চিম আঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া আসে এই হাটে। কুরবানির পর প্রথম হাট ঢিলেঢালাভাবে গেলেও দ্বিতীয় হাটের দিন ক্ষুদ্র ও মাঝারি চামড়া ব্যবসায়ীরা আশা করেছিলেন চামড়ার বাজার ভালো পাবেন। কিন্তু কাঁচা চামড়া কিনে প্রক্রিয়াজাত করাসহ মজুরির দাম বাড়তি খরচের খাতায় টুকতে হচ্ছে তাদের। দুরদুরন্ত থেকে যে দামে কাঁচা চামড়া কিনেছেন অনেকেই তার চেয়ে কম বা সামান্য লাভে চামড়া বিক্রি করে ঘরে ফিরছেন। এছাড়া, হাটের ইজারাদাররা আশানুরুপ পরিমাণ চামড়া পাচ্ছেন না হাটে। এবছর চামড়ার দামে ভয়াবহ পতন হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন ক্ষুদ্র ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
শনিবার সকালে রাজারহাটের চামড়ার বাজারে বড় গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা। মাঝারি গরুর চামড়া ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায় নেমে এসেছে। এদিকে ছাগলের দামড়ার বাজার দর একেবারেই নগন্য। প্রতি পিস ছাগলের চামড়া বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা দরে। সর্বোচ্চ ভালো মানের ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। কম দামে চামড়া বিক্রির কারণে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাইরের বড় ব্যবসায়ীরা না আসায় এবং একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় চামড়ার দাম সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এর ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজি হারাচ্ছেন এবং চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন।
খুলনা থেকে চামড়া বিক্রি করতে আসা ক্ষুদ্র বিক্রেতা হান্নান হালদার বলেন, এ বছর চামড়ার কোনো দাম নেই। বাইরের বড় ব্যবসায়ীরা আসেনি। ঘর মালিকরা যা দাম বলছে সেই দামে দিয়ে দিতে হচ্ছে। চামড়া কিনে তাতে ৭শ’ টাকা বস্তা দরের লবণ লাগাতে হয়। এছাড়া মজুরি খরচ আছে। গড়ে প্রতি পিস চামড়ার দাম পড়ে যায় ৫ থেকে ৭শ টাকা। বাজারে বিক্রি করতে এসে দাম বলছে সাড়ে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা। এমন একটা অবস্থা এই চামড়া ফেরত নিয়ে যেতে হলেও বাড়তি খরচ যোগ হবে। এই লস করে কেউ আগামিতে চামড়ার ব্যবসা করবে না।
বাগআঁচড়া এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, ৪শ পিস গরুর চামড়া নিয়ে এসেছি। সরকার নির্ধারিত দাম পাচ্ছি না। গড় হিসাবে ২৫ থেকে ৩৫ টাকা ফুট দাম পাচ্ছি। এ বছর লবণের দাম বাড়তি। সামনে দাম বাড়ার আশায় সংরক্ষণ করতে পারছি না। ব্যবসার অবস্থা এতটাই খারাপ আমাদের মত ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারাচ্ছে। ট্যানারি মালিকদের কাছে বছরের পর বছর ব্যবসায়ীদের টাকা পড়ে থাকছে। যাদের টাকা আছে তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে কিনে মজুদ করে রাখছে।
ডুমুরিয়া এলাকার ব্যবসায়ী আরাম দাস বলেন, তিনি গড়ে ৪০ টাকা পিস ছাগলের চামড়া কিনেছেন। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ থেকে ২০ টাকা পিস। একটু ভালো মানের হলে ৩০ থেকে ৪০ টাকা দাম পাচ্ছেন। এ বছর ব্যবসায় অনেক লস গুনতে হবে।
রাজারহাট চামড়া বাজারের ইজারাদার আল মামুন লিপো বলেন, এখন যথেষ্ট পরিমাণ চামড়া বাজারে আসছে না। ঈদ পরবর্তী সময়ে আজ ১৫ থেকে ২০ হাজার চামড়া বাজারে এসেছে। তবে এটা বিগত সময়ের তুলনায় নগন্য। ঈদের দীর্ঘ ছুটির কারণে ব্যাংক বন্ধ। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য চরম একটা ক্ষতি। কোনো ব্যবসায়ী ট্যানারি মালিকদের থেকে অর্থ পায়নি। যেকারণে তারা চামড়া কিনতে পারেননি।
তিনি আরও বলেন, চামড়া শিল্পকে অধুনিকায়ন করা গেলে বা বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এই ব্যবসায় লাভবান হওয়ার সুযোগ বাড়বে। এ বিষয়ে তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি সাঈদ আহমেদ নাসির শেফার্ড জানান, মঙ্গলবার প্রথম হাটে প্রায় ৬ হাজার গরুর চামড়া এসেছিল। আর শনিবার প্রায় ২০ হাজার গরুর চামড়া ও কিছু ছাগলের চামড়া আমদানি হয়। তবে দাম বাড়েনি। অধিকাংশ চামড়া ৫শ’ থেকে ৮শ’ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছে। তবে, ছোট ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েছেন। সরকারের নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের বাস্তবতার মিল না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।