কাজী নূর
‘ও রান্না করতে পারত, ফাস্টফুড তৈরি করতে পারত। আমি কখনো অসুস্থ হলে ও স্কুল থেকে এসে রান্না করে আমাকে খাবার খাইয়ে দিত। আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিত। ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চতা মেপে বলত, মা দেখো আমি তোমার চেয়ে বড় হয়ে গেছি। এখন তোমার আর কোন চিন্তা নেই। আমার দায়িত্ব আর তোমাকে নিতে হবে না। এখন থেকে তোমার দায়িত্ব আমার। ও আমার মেয়ের থেকেও বেশি ছিল। ছেলে আমার খুব অনুগত ছিল। যদি বলতাম দাঁড়িয়ে থাকতে, তাহলে দাঁড়িয়ে থাকতো, আবার যদি বলতাম বসো তাহলে বসে থাকতো। ও কখনো আমার অবাধ্য হয়নি।
যখন সবকিছুকে ওলটপালট করে দিয়ে বাসায় সাদের লাশ আসে তখন থমকে যায় আমার স্বপ্নের পৃথিবী। কারণ আমি আমার সাদকে নিয়ে অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম। কিন্তু জুলাই আন্দোলনে আমার সেই স্বপ্ন চিরতরে শেষ হয়ে গেল।
দুচোখে অশ্রুধারা আর থেমে থেমে বুকফাটা আর্তনাদ করে এভাবেই নাড়ি ছেড়া ধন প্রিয় সন্তানকে হারানোর বর্ণনা করছিলেন জুলাই আন্দোলনে নিহত যশোর শিক্ষাবোর্ড মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসির ছাত্র শহীদ সামিউর রহমান সাদ’র মা সাজেদা রহমান সাজু।
শনিবার সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসন যশোর ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর যশোরের আয়োজনে জেলা প্রশাসক যশোরের কার্যালয়ের অমিত্রাক্ষর সভাকক্ষে ‘জুলাইয়ের মায়েরা’ শীর্ষক এক অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে জুলাই আন্দোলনে নিহতদের অভিভাবক ও জুলাই যোদ্ধারা নানা স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন। অভিভাবক সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম।
‘জুলাইয়ের মায়েরা’ শীর্ষক অভিভাবক সমাবেশে মায়েদের স্মৃতিচারণ চলাকালীন গোটা মিলনায়তন স্তব্ধ হয়ে যায়। অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
জুলাই আন্দোলনে নিহত আরেক ছাত্র শহীদ আব্দুল্লাহর মা মারিয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে আব্দুল্লাহ বলেছিল, আর এক বছর ধৈর্য্য ধরো মা। এরপর আমি তোমাদের দায়িত্ব নেবো, তোমাদের সব কষ্ট লাঘব করে দেবো।
মারিয়া বেগম আরো বলেন, আন্দোলন চলাকালীন ছেলেকে বললাম বাড়িতে চলে আয় বাবা। তোর পছন্দের খাবার রান্না করে দেবো। ও বলল সামনের মাসে এসে খাবো মা। কিন্তু ও এলো ঠিকই তবে নিরব নিথর লাশ হয়ে। এখন ওকে বাড়ির সামনে শুইয়ে রেখেছি। রোজ ওকে চোখে চোখে রাখি।’
জুলাই আন্দোলনে রাজধানী ঢাকার রামপুরা বনশ্রীতে পুলিশের গুলিতে নিহত অনার্সের ছাত্র শহীদ ইমতিয়াজ আহমেদ জাবীরের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার জাবীর সবসময় বলতো মা আমি চাকরি করে তার প্রথম রোজগারে তোমাদের দু’জনকে হজ করাবো। কিন্তু তার আগেই সবকিছু কেড়ে নিল জুলাই আন্দোলন। তিনি দাবি করেন, জুলাই হত্যাকারীদের যেন বিচার করা হয়। এদেশের মাটিতে যেন আর কোন মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।
‘জুলাইয়ের মায়েরা’ শীর্ষক অভিভাবক সমাবেশে আগত অন্যান্য শহীদদের স্বজন এবং জুলাই যোদ্ধারা বলেন, জুলাই আন্দোলন নিহত এবং আহতদের উপরে বর্তমান বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, যেন এমন কোন পরিবেশ সৃষ্টি না হয় যাতে পুনরায় এদেশে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে যদি আবার ষড়যন্ত্র করা হয় তবে জুলাই যোদ্ধারা ফের রুখে দাঁড়াবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, আমরা যেন জুলাই বিপ্লবের কথা ভুলে না যাই। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে জুলাই বিপ্লব হয়েছিল সেটা যেন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি। যারা জুলাইয়ে নিষ্পাপ ছাত্রদের হত্যা করেছে, আহত করেছে তারা এখনো এদেশের মাটিতে রয়েছে এটা দুঃখজনক।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন যশোরের পুলিশ সুপার রওনক জাহান। বক্তব্য রাখেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ পরিচালক অনিতা মল্লিক, সিভিল সার্জন যশোর ডা. মাসুদ রানা, জুলাই যোদ্ধা পরিবারের আহবায়ক আহাদ হোসাইন, জাতীয় নাগরিক পার্টির জেলা সংগঠক মো. নুরুজ্জামান, জুলাইয়ের নারী যোদ্ধা খাদিজা আক্তার প্রমুখ।