বাংলার ভোর প্রতিবেদক
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে যশোরে পুষ্পমাল্য অর্পণ, আলোচনা সভা, সম্মাননা প্রদান ও বিজয় কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে শহীদ বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসের সূচনা করা হয়। পরে জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে বিজয় র্যালি বের করা হয়।
এদিন, জেলা শিল্পকলা একাডেমির হলরুমে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, পুলিশ সুপার রওনক জাহান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইমুন রেজা তালুকদার, জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ইয়াহিয়া জিসান, জেলা জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি আবুল হাশেম রেজা, লেখক ও গবেষক বেনজির খান, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক রাশেদ খান, জাতীয় নাগরিক পার্টি যশোরের সংগঠক নুরুজ্জামান, শহীদ আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল জব্বার, শহীদ জাবিরের পিতা নওশের আলী, আহত জুলাই যোদ্ধা মাসুম বিল্লাহ প্রমুখ।
পুলিশ সুপারের বক্তব্যের পরে দর্শক সারি থেকে উঠে মঞ্চে নারীদের বৈষম্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন খন্দকার রুবাইয়াত নামে এক নারী জুলাই যোদ্ধা।
খন্দকার রুবাইয়াত নামে ওই নারী জুলাই যোদ্ধা বলেন, আমাদের অনেকগুলো বক্তা বলে গেলেন যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র চান। আমি ও নিপা সরকার নামে একটা মেয়ে জেলায় প্রথম আন্দোলনে অংশ নিই। কিন্তু এই মঞ্চে একটাও মেয়ে নেই যে এই আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রেখেছিল। কেন নেই? এখানে ব্যানার আছে, ব্যানারে মেয়েদের ছবি সামনে দেওয়া আছে। যেখানে আমরা একটাও মেয়ে এখানে নেই। পুলিশের লাঠিচার্জে সিলভিয়া লাঠিচার্জের শিকার হয়েছিল, সে কি আহত যোদ্ধা হিসেবে থাকার কথা ছিল না? কেন নেই এখানে? এর দায় কে নেবে? বৈষম্যহীন রাষ্ট্র চান? কীভাবে রাষ্ট্র গড়বেন? নারীদের রেখে কীভাবে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গড়বেন আপনারা? যে নারীরা সংসার রেখে, বাচ্চা রেখে আন্দোলনে নেমেছিল, ভাইদের প্রটেস্ট করেছে সেই নারীরা কই মঞ্চে? তার জবাব কি কেউ দিতে পারবে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের ও ‘২৪-এর গণআন্দোলনের সকল যোদ্ধাদের। জুলাই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছিল শহীদ আবু সাঈদ। আন্দোলনের আইকন দুই হাত প্রসারিত করে, বুক পেতে দিয়ে এ দেশের স্বৈরাচারের যে ভিত, সে ভিতে যে কম্পন সৃষ্টি করেছে। আমাদের এই দিনটি আজীবন মনে থাকবে, যে আন্দোলনে মুগ্ধ তার অমলিন যে হাসি মাখা মুখ। হেসে হেসে যে জীবনকে তার সহযোদ্ধাদের পানি পান করিয়ে নিজের জীবনকে দান করেছে। অবাক করা বিষয়, ছোট্ট আনাস, যে আনাস আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য মাকে চিঠি লিখেছে যে আর কোনো দিন ঘরে ফিরে আসতে পারেনি। সে শহীদি কাফেলায় নাম লিখেছে। এটা সেই দিন।
তিনি আরও বলেন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বিষয়টা শেষ হয়ে যায়নি। যে বিপ্লবটা শুরু হয়েছিল সেই বিপ্লবকে থামানোর জন্য কতিপয় বুদ্ধিজীবী, সেই ফ্যাসিস্তদের দোসর, কায়দা করে, কানুন করে, কিতাবি ভাষায় সেটাকে ‘মবতন্ত্র’ নাম দিয়ে বিপ্লবকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যেখানে যেখানে বিপ্লবের কথা আসছে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা আসছে, সেখানেই তারা তাদের মতো করে শিরোনাম দিয়ে, বক্তব্য দিয়ে ন্যারেটিভ তৈরি করে সেখানে মবতন্ত্রের কথা বলছে। জুলাই আন্দোলন এখনও জীবিত আছে। যদি ঝিমিয়ে থাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। যদি সুপ্ত অবস্থায় আবার চলে যায় তাকে পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে।
জুলাই যোদ্ধার অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, আমাদের এক বোন বলেছেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে আমাদের একজন বোনকে মঞ্চে রাখা উচিত ছিল। আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে আমাদের ১১ জন বোন শহীদ হয়েছেন। আন্দোলনের সামনের কাতারে আমাদের বোনেরা ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই এই আন্দোলন শুধুমাত্র কোনো একক ব্যক্তির নয়। একক কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়, একক কোনো বর্গের নয়, একক কোনো জেন্ডারের নয়। এই আন্দোলনে সকল মানুষের সমান অংশগ্রহণ ছিল।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ। সাম্য, মানবিকতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেই মুক্তিযুদ্ধকে একটা দলীয়করণভাবে, তাদের একটা এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে দীর্ঘ ৫৪ বছর সেটিকে ব্যবহার করে এসেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধকে গণমানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ। কোনো একক গোষ্ঠীর নয়। কোনো একক ব্যক্তির এখানে কোনো কৃতিত্ব ছিল না। যেমনটি ‘২৪-এর গণবিপ্লবে সকল বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ আছে। শুধু ‘বিপ্লব, বিপ্লব’ বলে রাস্তাঘাট কাঁপিয়ে তুলে দেশ যদি পুনর্গঠিত না হয়, সেই বিপ্লব কখনো শান্তি বয়ে আনতে পারে না। আমাদের এখন দেশ পুনর্গঠন, রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের যে যন্ত্রগুলো আছে সে যন্ত্রগুলোকে সচল করতে হবে। তবেই জুলাইয়ের স্পিরিট, প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে পারব।
বিজয় র্যালি ও আলোচনা সভার আগে শহীদ বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন, জেলা প্রশাসন যশোর, পুলিশ সুপার যশোর, জেলা পরিষদ, সিআইডি যশোর, শহীদ পরিবার, যশোর পৌরসভা, সিভিল সার্জন যশোর, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, জেলা শিক্ষা অফিসার, আনসার ভিডিপি, সামাজিক বন বিভাগ, নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, হার্টিকালচার সেন্টার, ফায়ার সার্ভিস, জেলা বীজ প্রত্যায়ন অফিস, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, অগ্রণী ব্যাংক, এলজিইডি, জেলা কর্মসংস্থান, যশোর পল্লী বিদ্যুৎ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, বিএডিসি পরিবার, যশোর জেলা স্কুল, রেজিস্ট্রেশন বিভাগ যশোর জেলা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা সমবায় কার্যালয়, বিআরটিএ, জেলা পরিসংখ্যান বিভাগ, জয়তী সোসাইটি, ঔষধ প্রশাসন, সোনালী ব্যাংক, নির্বাহী প্রকৌশলী জনস্বাস্থ্য বিভাগ, প্রাচ্যসংঘ, বিসিক, ওজোপাডিকো, সরকারি গ্রন্থাগার, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিএসটিআই, পিটিআই, সড়ক বিভাগ, স্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর-১, এনজিও সমন্বয় যশোর, মাসুদুর খান ফাউন্ডেশন।