♦ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায় নৃশংস হত্যার শিকার
♦ তিনটি হত্যাসহ ৯ মামলার আসামি
♦ হত্যার কারণ তিনটি : পুলিশ
♦ বাবা-ভাইয়ের মতো একই পরিণতি
হাসান আদিত্য
এলাকায় দুই যুগেরও বেশি সময় ত্রাস ছিলেন যুবলীগ নেতা রেজাউল ইসলাম। বিগত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় খুন, জখম, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের আমলে দেশের সর্ববৃহৎ সবজির হাট সাতমাইল বারীনগর বাজারের ব্যবসায়ীরাও রেজাউলের আতঙ্কে থাকতেন চাঁদাবাজিতে। এলাকাবাসী বলছেন, যশোরের সিরিয়াল কিলার মোখলেছুর রহমান নান্নুর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন রেজাউল। বিগত সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেও বছর দুয়েক ধরে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায় ছিলেন। তার আগেই নৃশংস হত্যার শিকার হলেন তিনি। স্বজনদের দাবি, প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা তাকে নৃশংসভাবে করেছে। রেজাউলের বিরুদ্ধে ৩টি হত্যাসহ ৯ টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে রেজাউলকে নিজ বাড়ির সামনের রাস্তায় নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুবৃর্ত্তরা। পুলিশ বলছে, রেজাউলের গলায় ৪টি, ঘাড়ে ও বুকে ৫ টিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ১৩ টি ধারালো অস্ত্রের কোপ ও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শক্ত কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করার চিন্হও রয়েছে মরদেহের সুরতহালে। হত্যাকাণ্ডে ছুরি, চাপাতি ও শক্ত বস্তুর আঘাত রয়েছে। তাই এই হত্যাকান্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত রয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা। নিহত রেজাউল সদর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের দৌলতদিহি গ্রামের তরফদারপাড়ার মৃত গোলাম তরফদারের ছেলে। এই ঘটনায় বৃহস্পতিবার নিহতের ছেলে মেহেদী হাসান অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছেন। এই ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে পুলিশ বলে জানিয়েছে যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসনাত।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে রেজাউল ইসলামের বাড়িতে দেখা যায়, স্থানীয় ও নিকট আত্মীয়দের ভিড়। তাদের বাড়িতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদেরও দেখা গেছে। মামলার তদন্ত বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন তারা। নিহতের স্ত্রী শিউলি বেগম বলেন, ‘মঙ্গলবার রাত ১১ টার পরে খাওয়া-দাওয়া শেষে আমি আর আমার স্বামী রেজাউল ছাদে যায়। ওখানে দুজনে বসে কথাবার্তা বলছিলাম। এমন সময় তার ফোনে একটা কল আসে। নিচ থেকে একটা জামা নিয়ে বাইরে যায়। যাওয়ার আগে আমাকে বলে যায় চায়ের দোকানি যাচ্ছি। যাওয়ার পথেই সে হত্যার শিকার হন। সেই যে গেল, আর ফিরলো না। পরে স্থানীয়দের চিৎকার শুনে বাইরে বের হয়ে দেখি স্বামীর রক্তাক্ত নিথর দেহ।’
স্থানীয় জানান, রেজাউলের মরদেহ যেখানে পড়ে ছিলো বাড়ির প্রধান গেট থেকে দূরত্ব ৬০ গজের মতো। সড়কের দু’পাশের বাড়িঘর রয়েছে। তবে হত্যাকাণ্ডের সময় কেউ কোন শব্দ বা চিৎকার শুনতে পারেনি। এমনকি হত্যাকারীরা কোন গাড়িতে আসারও কোন শব্দ শুনতে পায়নি তারা। যেখানে হত্যার শিকার সেখানে গিয়ে দেখা গেছে রক্ত ছিটিয়ে রয়েছে।
নিহতের ভাইপো আরিফ হোসেন বলেন, ‘চাচা আগে রাজনীতি করতো। কোন পদ পদবী নাই। রাজনৈতিক নেতারা তাকে ব্যবহার করে সুবিধা নিতো। পরে মামলা হলে সটকে যেত। এটা যখন অনুধাবন করেন তিনি; তখন রাজনীতি থেকে সরে আসেন। নিয়মিত নামাজ ও কৃষি কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। যেহেতু কোন গাড়ির শব্দ পায়নি; তার মানে এই খুনে স্থানীয়রা জড়িত থাকতে পারে ধারণা করছি। নিহতের ভাগ্নি ময়না খাতুন জানান, দৌলতদিহি গ্রামের ওহাব, আইয়ুব খান, ফরিদ ও বাবলুর ইন্ধনে তার মামা রেজাউলকে খুন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, রেজাউল ইসলাম যশোর সদর উপজেলার শ্যামনগর গ্রামের সাইফুল ইসলাম সাফুর ছেলে ‘সিরিয়াল কিলার’ মোখলেছুর রহমান নান্নুর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল। হত্যাসহ অন্তত ২০ মামলার আসামি নান্নু ২০১৬ সালে ভারতে পালিয়ে যায়। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি ভারতে খুন হওয়ার পর রেজাউল প্রকাশ্যে আসে। খুন জখম চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে সাতমাইল বারীনগর বাজারের ব্যবসায়ীরা রেজাউলের আতঙ্কে থাকতেন। প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা তাকে নৃশংসভাবে করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এলাকায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
♦পুলিশের ধারণা তিনটি কারণে হত্যা
তদন্তে দায়িত্বে থাকা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মূলত তিনটি কারণে এই হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে। যেহেতু রেজাউল এলাকায় ত্রাস ছিলেন। আওয়ামী লীগের আমলে অনেক নেতাকর্মীদের নির্যাতন করার ঘটনা উঠে এসেছে। রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর তার প্রতিপক্ষরা এই ঘটনা ঘটাতে পারে। দ্বিতীয় সম্প্রতি স্থানীয় একটি ঘের ব্যবসায়ী হারুনের সঙ্গে স্থানীয় বাসুর সঙ্গে বিরোধ হয়। এক পর্যায়ে বাসুকে জবাই করতে তেড়ে যান হারুন। তখন হারুনকে আটক করে পুলিশে দেয় রেজাউল। এরপর থেকে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় তাদের। রেজাউল যেখানে হত্যার শিকার হয়েছে সেই জায়গা হারুনের বাড়ি থেকে ৫০ গজ দূরে। আর তৃতীয় হলো ধর্মীয় লেবাসে থাকলেও সম্প্রতি রেজাউল মাদকের উপর আসক্ত হয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে এলাকায় মাদক বেচাকেনা নিয়ে এক ধরনের গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রতি ইয়াবার একটি চালান আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেছে। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিপক্ষরা এই ঘটনা ঘটাতে পারেন বলে ধারণা করছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
♦বাবা-ভাইয়ের মতো একই পরিণতি
১৯৮৭ সালের দিকে রেজাউলের বাবা গোলাম তরফদার ও ভাই ইনছার তরফদারকে নিজ বাড়িতে হামলা চালিয়ে পিটিয়ে খুন করে প্রতিপক্ষ। তিন দশক পরে এবার রেজাউলের একই পরিণতি ভোগ করতে হলো।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবুল বাশার বলেন, ‘তদন্ত চলছে। কিছু ক্লু পাওয়া গেছে। দ্রুতই রহস্য উদঘাটন করা হবে।’