স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
১৪ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশের পঞ্চম বৃহত্তম পৌরসভা যশোর। এখানে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এই শহরে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সকাল থেকেই চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে খেঁজুর গুড়, ফুল-পাখি আর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত এই শহর।
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম জেলা হওয়ায় যশোরের নাম বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেছে। সেই খ্যাতিতে বিশেষত্ব যোগ করেছেন মানকুমারি বসু, মধুসূদন দত্তের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা। এই সুখ্যাতি থাকলেও দীর্ঘ বছর ধরে শহরের যানজট ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন আসেনি।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন সাধারণ পথচারীরা। যত্রতত্র রিকশা, ইজিবাইকের জটলা লেগেই থাকে। বিশেষ করে সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে মূল শহরে প্রবেশ করার মতো পরিবেশ থাকে না। ইজিবাইক, রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেট কার, বাস, মোটরসাইকেল সবকিছুই চলে একই পথে।
ইজিবাইক-রিকশার খামখেয়ালি আচরণে ইউটার্ন যানজট সৃষ্টি করে। এছাড়াও রয়েছে ফুটপাত দখল ও ভ্রাম্যমাণ স্ট্যান্ড। ফুটপাত দখল করে একদিকে যেমন ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ভ্রাম্যমাণ দোকান তৈরি করেছেন, অন্যদিকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরকারি রাস্তার ফুটপাতে নিজ উদ্যোগে টাইলস লাগিয়ে দখল করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিকেল ৫টার পর শহরের দড়াটানা থেকে হাসপাতাল মোড়ের দুই মিনিটের পথ পার হতে ন্যূনতম আধা ঘণ্টা সময় লাগে। শহরের যানজট নিরসনে ট্র্যাফিক বিভাগ কাজ করলেও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না।
যশোর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, পৌর এলাকার ভেতরে মোটরচালিত রিকশা চলাচলের কোনো অনুমতি নেই। বিগত সময়ে ২ হাজার ৯৯৩টি পায়ে-চালিত রিকশা, ৪ হাজার ৪৬৮টি ইজিবাইক ও ৩০০টি ভ্যান গাড়ির জন্য লাইসেন্স দেওয়া আছে। তবে, পায়ে-চালিত রিকশার অনুমোদনের আড়ালে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কয়েক হাজার মোটরচালিত রিকশা শহরজুড়ে চষে বেড়াচ্ছে।
সূত্র বলছে, অনুমোদন না থাকলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় শহরের বেশ কিছু এলাকায় গ্যারেজ ও হোল্ডিং এর দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে অর্ধশতাধিক মোটরচালিত রিকশা তৈরি হচ্ছে।
রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব মোটরচালিত রিকশা নিয়ে গ্যারেজ তৈরি করছেন। সেখানে ২৫০ টাকা দৈনিক চুক্তিতে খুব সহজে একদিনের জন্য রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়। এই ভাড়ায় চালিত রিকশা পেতে মালিকের কাছে জমা রাখতে হয় ভোটার আইডি কার্ড ও এক কপি ছবি। যে কোনো মাধ্যমে যে কোনো বয়সের মানুষ গ্যারেজ মালিকের শরণাপন্ন হলে বয়সের বিবেচনা না করে গ্যারেজ মালিক চালকের হাতে রিকশার চাবি তুলে দেন। কথিত আছে, যশোর শহরে একটা বিনা-পুঁজির ব্যবসা আছে, যেটা হলো রিকশা-ইজিবাইক চালানো। যশোর শহরে এই যানবাহন চালাতে চালকের কোনো লাইসেন্সের প্রয়োজন পড়ে না, দরকার হয় না নির্দিষ্ট কোনো বয়সেরও।
অন্যদিকে, শহরে নেই কোনো সাইন-মার্ক, জেব্রা-ক্রসিং বা ট্র্যাফিক সিগনাল লাইট। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণ আনা যাচ্ছে না। এছাড়াও রিকশা-ইজিবাইকের “পিপ পিপ” শব্দ তো লেগেই আছে।
কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা থেকে রেলগেট মোড় এবং দড়াটানা থেকে নিউ মার্কেট এলাকা। একইভাবে, দড়াটানা থেকে মণিহার মোড় ও দড়াটানা থেকে বিমান অফিস মোড় এলাকা পর্যন্ত সড়কে দিনে দুই বেলা গড়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে। শহরের এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কের অংশে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশেষ করে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা এবং বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত এই অঞ্চলে যানজট লেগে থাকে।
যানজটের মূল কারণ হিসেবে জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হলেও এর ভেতরে রয়েছে আরও কিছু কারণ। এই সব এলাকায় প্রায় ৩০টি অস্থায়ী যানবাহনের স্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। এসব স্ট্যান্ডে একের পর এক যানবাহন অবস্থান করে থাকে। যেখানে দিনে গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার গাড়ি অবস্থান করে।
যশোর পৌরসভার নির্দিষ্ট কতগুলো স্ট্যান্ড রয়েছে এবং সেই স্ট্যান্ডগুলোর ঠিক কতগুলো যানবাহন ধারণক্ষমতা রয়েছে। এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়াও রয়েছে একাধিক স্থায়ী-অস্থায়ী পার্কিং এরিয়া। এই পার্কিং এরিয়াগুলো মূল সড়কের লাগোয়া, যে কারণে গাড়ি পার্কিংয়ের সময় সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সড়কের অনেক অংশে ফুটপাত না থাকার কারণে বা ফুটপাত দখলের কারণে সাধারণ পথচারীরা সড়কের যত্রতত্র চলাচল করে। জেব্রা-ক্রসিং বা রোড সিগনাল না থাকার কারণে সড়ক পারাপারেও দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
যানজটের বিষয়ে আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাদেরকে জানিয়েছেন, কঠোর আইনের প্রয়োগ, সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে শহরের যানজট তৈরি হচ্ছে।
তন্ময় কুমার রায় নামে এক কলেজছাত্র বলেন, শহরে চলাচলের মতো পরিবেশ নেই। এত যানজট যে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হওয়াও কঠিন। দড়াটানা ব্রিজ পার হওয়াটা জরুরি। অনেক সময় পায়ে হেটে যানজট এড়িয়ে পুনরায় গাড়িতে উঠতে হয়। এতে করে বাড়তি অর্থ ও সময় নষ্ট হয়।
রমজান আলী নামে এক ইজিবাইক চালক বলেন, সকাল থেকে গ্রামগঞ্জ থেকে রিকশা-ইজিবাইক শহরে চলে আসে। সারাদিন শহরে অবস্থান করে যাত্রী টানে। হাসপাতাল এলাকায় রোগী নিয়ে যাওয়ার মতোও পরিবেশ নেই। মাঝে মাঝে প্রশাসন নামমাত্র যানজট নিরসনে কাজ করে। দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। ভুক্তভোগী আমরা যারা ১৪ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স করে ভাড়া টানি। গ্রাম থেকে ইজিবাইক চলে আসে, ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে তারা মূল শহরে ঢুকে পড়ছে। এসব দেখার কেউ নেই।
যশোর পৌরসভার সহকারী লাইসেন্স পরিদর্শক মঞ্জুর হোসেন স্বপন জানান, পৌর এলাকার ভেতরে মোটরচালিত যানবাহনের নিবন্ধন বন্ধ রয়েছে। পায়ে-চালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইকের লাইসেন্স নবায়নের কাজ চলমান রয়েছে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা পুলিশের ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে যশোর পৌরসভার প্রশাসক রফিকুল হাসান বলেন, ট্র্যাফিক পুলিশ, যশোর পৌরসভা, জেলা প্রশাসন, সবাই মিলে যানজট নিরসনে কাজ করতে হবে। আমরা কাজ করতে চাই। এবার উদ্যোগ নিয়েছি, লাইসেন্সবিহীন কোনো গাড়ি মূল শহরে প্রবেশ না করলে যানজট হবে না।
ফুট-ওভার ব্রিজ করার চিন্তাভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে এটা করতে পারে। তারা আমাদের লিখিত দিলে আমরা পৌরসভার পক্ষ থেকে চেষ্টা করব। সড়কের আইল্যান্ডগুলো আমরা দ্রুত রং করাবো। ইতিমধ্যে প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ পথচারীদের মতো আমাদেরও ব্যক্তিগতভাবে চলাচল করতে অনেক কষ্ট হয়। ফুটপাতগুলো দখল করে রেখেছে। সকালে দখলমুক্ত করলে বিকেলে আবার বসছে। সব মিলিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব।