♦ জনপ্রতিনিধির পলাতক থাকায় ভোগান্তি লাঘবে ইউপি প্রশাসক নিয়োগ
♦ উপজেলা, পৌরসভা ও জিলা পরিষদ বিলুপ্ত করায় ক্ষমতা হারিয়েছে অনেকেই
♦ কেউ কেউ নিজ দপ্তরে ফেরার চেষ্টা করলেও মবের ভয়ে পিছু হঠেন
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর সদরের আরবপুর ইউনিয়নে দুইবারের ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারসহ শীর্ষনেতাদের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় দুটি নির্বাচনেই জয়ী হতে বেগ পেতে হয়নি তার। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী এই নেতা জনপ্রতিনিধির চেয়ারে বসে এলাকায় করেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব। সন্ত্রাসীবাহিনী গড়ে তুলে দখল, বিরোধী নেতাকর্মীদের উপর করেছিলেন হামলা, মামলা নির্যাতন। ‘শাহারুল বাহিনীর’ হাত থেকে রেহায় পায়নি অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও। নামে দলীয় নেতাকর্মী হত্যার ইন্ধনদাতা হিসেবেও হয়েছে তার নামে চার্জশিট। বিতর্কিত ও দাপুটে এই জনপ্রতিনিধি ক্ষমতার পালাবদলে নিজ কৃতকর্মের রোষানল থেকে বাঁচতে রয়েছেন আত্মগোপনে।
শুধু এই ইউনিয়ন নয়, যশোরে ৪৪টি ইউনিয়ন, আট উপজেলা ও পৌরসভা ও জেলা পরিষদের ১৮৫ জনপ্রতিনিধি রয়েছেন আত্মগোপনে। সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্থানীয় সরকারের বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ এসব দপ্তরে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে কেউ গড়েছিলেন সন্ত্রাসীবাহিনী। কেউ বা ক্ষমতার চেয়ারে বসে লুটপাটের সঙ্গে বিরোধী নেতাকর্মীদের উপর চালিয়েছেন হামলা, মামলা নির্যাতন। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগপন্থি এসব জনপ্রতিনিধিরা হামলা, মামলার ভয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রোষানল থেকে বাঁচতে আসেননি নিজ নিজ দপ্তরে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা জনপ্রতিনিধিদের দপ্তরে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন এসব প্রশাসক উপস্থিত না থাকায় কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তারা বলছেন, নিজেদের কৃতকর্মে জনপ্রতিনিধিদের পলায়নে ভোগান্তির ভাগিদার জনগণ। যদিও কেউ কেউ নিজ দপ্তরে ফেরার চেষ্টা করলেও স্থানীয় বিএনপি, বিক্ষুদ্ধ জনতার মবের শিকারে তারা পিছু হঠেন। আবার অনেক জায়গায় জনপ্রতিনিধিদের কার্যালয় ভাংচুর ও তালা মেরে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
সদরের আরবপুর ইউনিয়নের প্রধান ফটকের সামনে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। দোকানটির মালিক বাদল। স্থানীয় বিএনপির কর্মী। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে নিয়মিত দোকানদারি করতে পারতেন না। অভিযোগ করে বলেন, ‘ভিন্নমতের রাজনীতি করার কারণে শাহারুল চেয়ারম্যান আমার উপর নির্যাতন করেছে। মামলা দিয়েছে। দিনের পর দিন বাড়ি ছাড়া। শুধু আমি না, ইউনিয়নের চাঁচড়া, পুলেরহাট এলাকাসহ নিরীহ মানুষের জমি দখল করেছে। বিচার শালিসের নামে তার বাহিনীর সদস্যরা জুলুম করেছে। নদী দখল করে মাছ চাষ করেছে। উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে। তার নির্যাতনে বাদ যায়নি নিজ দলের নেতাকর্মীরাও। উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা দাদা রিপন হত্যার ইন্ধনদাতাও ছিলেন প্রতাপশালী এই চেয়ারম্যান। সময়ের পরিবর্তে তিনি আজ পলাতক। ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বিগত সময়ে চেয়ারম্যান ছিলেন সোহরাব হোসেন। স্থানীয় এমপির প্রভাবে এলাকায় সন্ত্রাসীবাহিনী গড়ে তোলেন। ভিন্নমতের রাজনীতি করায়, তার নির্যাতনে থাকতে পারেনি এলাকায়। বিভিন্ন প্রকল্প লুটপাটের শিরোনামও হয়েছে এই চেয়ারম্যান।’
যশোর শহরের নাগরিক অধিকারের নেতা জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান-মেয়রদের নাম থাকলেও নিজ কৃতকর্মের জন্য বাপ মার দেয়া নামের সাথে ভিন্ন নামও যোগ হয়। যেমন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন পিকুল।
জেলার সড়কগুলোর গাছ কেটে লুটপাট করায় জনগণ নাম দিয়েছিলো ‘গাছ খেকো পিকুল।’ তারা আজ পলাতক। নিজেদের কৃতকর্মে পলাতক হলেও সেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনগণকে। প্রশাসক নিয়োগ হলেও কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না এসব প্রতিষ্ঠানে।’
নিজ দপ্তরে ফেরার চেষ্টা করলেও মবের শিকারে পিছু হঠেন অনেকেই
গত বছরের ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে ছিলেন কেশবপুরের ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম আনিছুর রহমান। আত্মগোপনে থেকে ইউপি মেম্বারদের মাধ্যমে দাপ্তরিক কিছু কাজ করছিলেন। হঠাৎ চলতি বছরের ৩১ মে আনিছুর রহমান ইউনিয়ন পরিষদে গেলে বিক্ষোভ করে চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। এরপর তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষের নামফলক ও তালা ভেঙে নতুন একটি তালা ঝুলিয়ে দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও সাতবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক শামছুল আলম (বুলবুল), ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেন, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক অহিদুর রহমান এবং স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আকরাম হোসেন বলেন, ‘বিএনপি এবং সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। চেয়ারম্যান আনিছুর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট। নির্যাতন-লুটপাট করেছে।’
চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি কেশবপুরের সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা দেয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন আহত হয়। ইউপি চেয়ারম্যান কাজী মুস্তাফিজুল ইসলাম গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও তিনি স্বাভাবিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। তবে ঘটনার দিন সকালে স্থানীয় ছাত্র-জনতা ওই ইউপি চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে সমবেত হয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে তালা লাগিয়ে দেন। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে ঘটে সংঘর্ষ। এর পরে চেয়ারম্যান আর পরিষদে আসেননি। নিয়োগ দেয়া হয় প্রশাসক। এরপর সুফলাকাঠিসহ জেলার অন্তত ১৫টি পরিষদে মব সৃষ্টি করে তালা দেয়া হয়। জেলার ৯৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৪টি ইউনিয়নে প্রশাসক ও প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করলেও বাকি ইউপিতে চেয়ারম্যানরা নিয়মিত আসেন না বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। কারণ হিসেবে একাধিক চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, পরিষদের কাজে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা হস্তক্ষেপ করছেন। তাদের কথা না শুনলে দোসর আখ্যা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়া বা মব সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা করছেন।’
তবে এ ধরনের ঘটনাকে আতঙ্ক ও উদ্বেগের বলে জানিয়েছেন যশোর নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক শেখ মাসুদুজ্জামান মিঠু। তিনি বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে তারা তো পালিয়েছে। কিন্তু অনেকেই ব্যবসায়ী ছিলেন, অপেক্ষাকৃত কম সমালোচিত যারা ছিলেন তারা ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের উপর মব সৃষ্টি করে পরিষদে তালা দেয়া ভাংচুরের ঘটনা করেছে। এটা দুঃখজনক। এখন স্থানীয় সরকার বিভাগে জনপ্রতিনিধি না থাকায় ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের। ভোটের মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রতিনিধি দায়িত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
তবে জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি হয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন না করে জনগণের উপর নির্যাতন করেছে। ফলে জনরোষে পড়ার ভয়ে তারা আত্মগোপনে। তবে মবসৃষ্টি করে কাউকে সরানো কোন রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নয় বলে জানান তিনি। ইতোমধ্যে কয়েক নেতাকে বহিস্কার করা ও নেতাকর্মীদের হুশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে দাবি করেন তিনি।’