বাংলার ভোর প্রতিবেদক
একেকটা মাছের ওজন ৫ থেকে ১৫ কেজি পর্যন্ত। এক জায়গায় মেলে দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ। স্থানীয় জামাইদের মধ্যে চলে বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা। এই মাছ নিয়ে যাবেন শ্বশুর বাড়িতে, সাথে মুখরোচক খাবারও। এ দিয়েই আনন্দ উদযাপন করবেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাইতো এই মেলার নাম দেয়া হয়েছে ‘জামাই মেলা’। দুর্গা পূজার বিজয়া দশমীর দিনে ৭৫ বছর ধরে ব্যতিক্রমী এই মেলা বসে যশোরের মণিরামপুরের ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে। নানা জাতের মাছ দেখতে ভিড় জমায় নানা বয়সী মানুষও। সময়ের সাথে সাথে ব্যতিক্রমী এই মেলা উৎসবে পরিণত হয়েছে।
একদিনের মাছের মেলায় বিক্রি হয় কোটি টাকার মাছ! তবে, বাজারমূল্যের চেয়ে মেলায় কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হওয়ার অভিযোগ ক্রেতাদের।
যশোর শহরে থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে মণিরামপুর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ঢাকুরিয়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে বছরের পর বছর বসে জামাই মেলা। শুক্রবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সের ও ধর্মবর্ণের শত শত বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। মেলায় বড় বড় রুই কাতলা, ব্লাক কার্প, সিলভার কার্প, ইলিশ, পাঙ্গাস, চিংড়িসহ নানা প্রজাতির মাছ তোলা হয়েছে। মাছের বাইরে রাঁজহাস, পাতিহাসও বিক্রির জন্য ব্যবসায়ীদের বসে থাকতে দেখা গেছে। কেউ শ্যালক শ্যালিকাদের নিয়ে জামাইরা বাজারে মাছ কিনতে এসেছেন।
কেউ বা সন্তান স্ত্রীদের নিয়ে মাছ কিনতে এসেছেন। তবে সবাই যে হিন্দু ধর্মের অনুসারী তা কিন্তু নয়; মুসলিম ধর্মের অনুসারীরাও মাছ কিনতে এসেছেন এই মেলায়। বছরের পর বছর এই মেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ সৃষ্টি করে মেলা হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে কারো কাছে মাছের বাজার সস্তা আবার কারো কাছে চড়া।
একহাতে সাড়ে ৮ কেজি ওজনের কাতলা মাছ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রদীপ কুমার বাইন। মেলা মাঠে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘মেলার সামনে রাস্তায় একটি ভ্যানে বউ আর মেয়ে বসে আছে। চিনেটোলায় শ্বশুর বাড়ি। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনে শ্বশুর বাড়ি যাই। যাওয়ার সময় এই মেলা থেকে বড় মাছ নিয়ে যাই। মাছের সঙ্গে মুড়ি মুড়কি, জিলাপিও। শ্বশুর বাড়িতে আনন্দ করে সবাই চলে খাওয়া দাওয়া।’
শ্যামল বিশ্বাস নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাজারে মাছ কম দেখছি। এলাকার জামাইদের প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনার অঘোষিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মণিরামপুর না, অভয়নগর ও সদর উপজেলার লোক এসেও এখান থেকে মাছ কিনে নিয়ে যায়। শুধু যে হিন্দু ধর্মের মানুষ মাছ কিনে এটা কিন্তু না; মুসলিম ধর্মের মানুষ দল বেঁধে এসে মাছ কিনে নিয়ে যায়। তিনি জানালেন সাড়ে ৮ শ’ টাকা কেজি করে সাড়ে চার কেজি ওজনের মাছ নিয়েছি।’
এই মেলায় ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে মাছ বিক্রি করেন শংকর বিশ্বাস। তিনি জানালেন, তার নিজস্ব একটা ঘের রয়েছে। সেই ঘের থেকে আজ ভোরে মাছ ধরে ১০টার দিকে মেলায় মাছ এনেছেন। মেলায় রুই, কাতলা বেশি চলে। তাই ঘেরের সবচেয়ে বড় বড় মাছ ধরে মেলায় এনেছি। এখন পর্যন্ত সাড়ে ১২ কেজি ওজনের একটা মাছ বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, দূরদূরান্ত থেকে এখানে মাছ কিনতে আসে মানুষ। শুধু জামাইরা না; বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে আসে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মাছ কম। অতিবৃষ্টিতে ঘের ভেসে যাওয়ায় এই অঞ্চলে বড় মাছ কম। ভবদহ অঞ্চল হওয়াতে ৬ মাসের বেশি সময় জলাবদ্ধতা। ফলে ফসলফলাদি নেই। টাকার সংকটে অনেকেরই বড় মাছের দিকে ঝোক কম। তারপরেও জামাইদের মনস্তাত্ত্বিক এই প্রতিযোগিতায় বড় মাছই আসল কেন্দ্রবিন্দু।’
স্থানীয়রা জানান, মেলা ঘিরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের বাড়িতে মেয়ে, জামাই ও নাতি-নাতনিরা এসে ভরে গেছেন। তাদের মেলার মাছসহ বিভিন্ন খাবার দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি হরেক রকম পিঠাপুলিও রয়েছে। অনেক জামাই মেলা থেকে সাধ্যমতো মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে ফেরেন। তবে এই মেলাটি অনেক বিক্রিতা মাছের পসরা বসালেও সম্প্রতি একটি দ্বন্দ্বে মেলার একটি অংশের বিক্রেতারা মেলায় দোকান বসায়নি। তারা বসিয়েছে বাজারের মূল মাছ বাজারে। ফলে মেলায় বিক্রেতাও কম।
ঢাকুরিয়া প্রতাপকাটি বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নান গাজি বলেন, ‘১৯৫০ সাল থেকে এই মেলা বসে। এ মেলা এখানকার একটি ঐতিহ্য। এখানকার জামাইরা প্রতিযোগিতা করে মাছ কেনে। মেলাকে ঘিরে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানও বসে। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি। দিনব্যাপি এই মেলায় কোটি টাকার উপরে মাছ বিক্রি হয় বলে দাবি করেন তিনি।’