বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ভাঙা টিনের চাল। সেই ঘরের দেয়ালও টিনের। তাও ক্ষয় হয়েছে অনেকটাই। ঘরটির সামনে ছোট উঠান। মাঝারি আম গাছের ডালপালা ভেদ করে সেই উঠানে ঝলমলিয়ে প্রবেশ করেছে শীতের মিষ্টি রোদ। প্লাস্টিকের চেয়ারে কয়েকজন নারী সেই রোদ পোহাচ্ছেন। ছোট্ট সেই উঠোনে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করছে প্রাণোচ্ছ্বলে ভরপুর তিন বছরের শিশু। নাম জিজ্ঞাসা করতেই আধো আধো ভাঙা বুলিতে জানিয়ে দিলেন আফিয়া। আফিয়ার বয়স যখন ৮ মাস, সেই সময় তার মা মনিরা খাতুনকে তালাক দেন মোজাফ্ফর হোসেন। মনিরার অপরাধ, তিনি যে শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ করেছেন- তার ত্বক ও মাথার চুল সাধারণ বাচ্চাদের মতো নয়। আফিয়ার ত্বক দুধসাদা, মাথার চুল ও ভ্রু হালকা ঘিয়ে রঙের। তার স্বামীর দাবি, ওই সন্তান তার ঔরসে নয়। সেই কারণে তিনি তাকে তালাক দিয়েছেন। মনিরার বাড়ি যশোর সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাজুয়াডাঙ্গা পশ্চিমপাড়ায়। তিনি দিনমজুর শহিদ মোল্লার মেয়ে। বর্তমানে আফিয়া ও মনিরা নানার বাড়িতেই বসাবস করছেন।
স্থানীয়রা জানান, যশোর সদর উপজেলার বাউলিয়া চাঁদপাড়া গ্রামের মোজাফফর হোসেনের সাথে ২০২০ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় কুয়াদা বাজুয়াডাঙ্গা গ্রামের মনিরা খাতুনের। এরপর ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর এই দম্পতির ঘর আলো করে আসে একটি কন্যা শিশু আফিয়া। তবে শিশুটি দেখতে অনেকটা ইউরোপীয়দের মত। আর এতেই বিপত্তি ঘটে। অপবাদ দিয়ে স্বামী মোজাফফর তালাক দেন স্ত্রী মনিরাকে। নবজাতক মেয়েকে ত্যাগ করে চলে যান প্রবাসে। মনিরার দুর্দিনে আপন কেউ পাশে নেই। প্রতিবেশীরা খোঁজখবর নিলেও জীবন সংগ্রামে একা শিশুটিকে নিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন তিনি। মনিরা খাতুন বলেন, ‘আফিয়া জন্মের পরপরই ওর বাবা আমাকে নানা অপবাদ দিতে শুরু করে। মেয়ে তার না। আমার অন্য কারো সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল। আমি বারবার বলেও তাকে বোঝাতে পারিনি। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে বাবার বাড়িতে পাঠায়ে দেয়। পরে ৭ থেকে ৮ মাস পর আমাকে তালাক দিয়ে না জানিয়ে বিদেশে চলে যায়। এরপর থেকে এখনো পর্যন্ত আমার ও আমার মেয়ের কোনো খোঁজ নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বাবার বাড়িতে এই ভাঙা ঘরে মেয়েকে নিয়ে অনিরাপদ জীবনযাপন করছি। লোকের বাড়ি কাজ করে কোনোরকম বাচ্চাটার মুখে কিছু তুলে দিতে পারছি। বাবা একজন দিনমজুর, ঘরে সৎমা। কোনো ভাই নেই। কোনো অপরাধ না করেও আমি আর আমার সন্তান শাস্তি পাচ্ছি।’ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আফিয়া যখন তার বাবাকে খোঁজ করে; তখন আমার বলার কোন ভাষা থাকে না। বুকটা ফেঁটে যায়। মাঝে মধ্যে বলি তার বাবা বিদেশে থাকে। তাই সে মোবাইল কানে দিয়ে বলে বাবা তুমি কেমন আছো? তোমার কোলে যাবো। আসার সময় তুমি টকলেট, পুতুল, নতুন জামা নিয়ে আসবা।’
স্থানীয়রা জানান, অভাবের সংসার আর সৎ মায়ের ঘরে বড় হয়েছেন মনিরা। বিয়ের পর নতুন জীবন ফিরে পাবেন এমন প্রত্যাশা দুঃস্বপ্নে রুপ নিয়েছে তার। শঙ্কা মেয়ে আফিয়া’কে নিয়েও। পিতার এমন নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে হতবাক ও ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা করেও সমাধান হয়নি বলে জানিয়েছেন মনিরার বাবা শহিদ মোল্লা।
হতদরিদ্র পরিবারে মেয়ে ও নাতীকে নিয়ে বেসামাল তিনি। এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন শিশুটি ও মেয়েকে গ্রহণ করবেন তার জামাই। তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের ২১ মে স্থানীয়দের সহযোগিতায় একটি সালিশ হয়। সেই সময় স্বামী মোজাফফরের পক্ষে তার বড় ভাই আবু বক্কর আফিয়ার খরচ বাবদ প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করেন; কিন্তু দুই বছর পার হলেও কোনো টাকা দেয়নি। ফলে সন্তানকে নিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন তিনি। এমনকি মোজাফফরের নাম্বারটি পর্যন্ত দেয়নি তারা।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে এগিয়ে এসেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। শুক্রবার দুপুরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে শিশু আফিয়াকে দেখতে যান বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম। বসতঘর নির্মাণ করে দেয়ার পাশাপাশি শিশু আফিয়ার পড়াশোনার পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন তারেক রহমান। অমিত বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। একই সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নজরে এলে তিনি পরিবারটির দায়িত্ব নিতে বলেন। মনিরার থাকার মতো কোনো আবাসস্থল নেই, সেজন্য একটি ঘর নির্মাণ ও আফিয়ার লেখাপড়ার দায়িত্ব দলের পক্ষ থেকে নেয়া হবে।’
এদিকে, মনিরা ও আফিয়াকে আইনি ও নাগরিক সহযোগিতা দিতে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের পাশাপাশি এগিয়ে আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন।

