# যশোর ৭ মাসে দুই শতাধিক অভিযোগ জমা
# বহিস্কার-পদ স্থগিত ও শোকজ দেড় শতাধিক
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোরের মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ের এক কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মোতাহারুল ইসলাম রিয়াদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীর দাবি, গত ৫ মার্চ বুধবার বিকেল ইউএনও কার্যালয় সংলগ্ন শহীদ মিনারের সামনে তাকে মারধর করা হয়। ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তির নাম শাহীন আলম। তিনি ইউএনও কার্যালয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত। ঘটনার একদিন পর শাহীনকে মারধরের প্রতিবাদে ইউএনও’র নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মানববন্ধন করেন। এই ঘটনার পর থেকে বিএনপির এক অংশের সাথে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে বৈরিতা চলছে। যদিও ইউএনও অফিসের কর্মচারীকে মারধরের ঘটনায় মোতাহারুলকে বহিস্কার করেছে যুবদল।
একই দিন সকালে সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতার ১৫৫ বস্তা চাল বাগআঁচড়া খাদ্য গুদাম থেকে ডিলারের কাছে পৌছানোর সময় লুটের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি রুহুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে। প্রশাসনের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা বিএনপি রুহুলের সব পদ স্থগিত করেছে। যদিও ঘটনার একদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে চাল লুটের অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছেন রুহুল কুদ্দুস।
ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর যশোরে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে উঠে আসছে একের পর অনিয়মের অভিযোগ। তবে এসব বিষয়ে প্রথম থেকেই বেশ কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে দলটির জেলার শীর্ষনেতাদের। বিভিন্ন অভিযোগে এরই মধ্যে বহিস্কার ও শোকজ করা হয়েছে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড উপজেলা এমনকি জেলার পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। এছাড়া নেতাকর্মীদের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে গঠন করা হয়েছে মনিটরিং সেলও। তবে শীর্ষনেতাদের এতো সব পদক্ষেপের পরেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না যশোরের বিএনপির নেতাকর্মীদের।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রথম দিন থেকে বেড়েছে দলটির নেতাকর্মীদের দখল, রাজনীতিক প্রতিহিংসার দৌরাত্ম্য। দোকানপাট, নওয়াপাড়া নৌ বন্দরঘাট, মৎস্য ঘের, জায়গাজমি, মার্কেট সর্বত্র দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীর নামে অভিযোগ জমা পড়েছে জেলা বিএনপির কাছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা, নগর ও উপজেলার শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিস্কার করা হয়েছে। পদ স্থগিত করা হয়েছে অন্তত ৩০ জনকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখানো হয়েছে। শনিবার নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে যশোর জেলা বিএনপি। বিজ্ঞপ্তিতে, নেতাকর্মীদের প্রতি সাতটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর যশোরের নওয়পাড়া নৌ বন্দর অন্তত ২০টি ঘাট দখলে নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। নওয়াপাড়া ৬ নম্বরে ওয়ার্ডে অবস্থিত দুই দশকের বেশি সময় ধরে আবাহনী ক্রীড়া চক্র দখল করে স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয় ও কোকো ক্রীড়া চক্র অফিস করেছেন নওয়াপাড়া বিএনপির নেতাকর্মীরা। যদিও এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকায় প্রকাশ্য কোন অভিযোগ করেনি। যদিও ঘাট দখলসহ নানা অভিযোগে নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান জনির পদ ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্থগিত করেছে বিএনপি।
যশোরের গদখালী পাইকারি ফুলের মোকামের শতাধিক ব্যবসায়ীর ফুলের ব্যবসা দখলের অভিযোগ উঠেছে বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের হুমকিতে চার মাস ধরে ওই ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে পারছেন না। ফুল ব্যবসায়ী না হয়েও গদখালী ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির কার্যালয় দখলে নিয়েছেন নেতারা।
ফুল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিএনপি ও যুবদলের লোকজন ব্যবসা কেড়ে নেওয়ায় শতাধিক ব্যবসায়ী মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এই ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে ফুল কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। কেউ প্রতিবাদ করলে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গদখালী ও পানিসারা এলাকার অন্তত ছয় হাজার ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে বিএনপি নেতা আবুল খায়ের বলেন, ‘এই সমিতির তেমন কার্যকারিতা ছিল না। তা ছাড়া এত দিন আওয়ামী লীগের লোকজনের দখলে ছিল সমিতির নেতৃত্ব। আমরা নতুন কমিটি গঠন করেছি। এতে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা খুশি। কারও ব্যবসায় বাধা দেয়া হচ্ছে না।
দেশের অন্যতম বৃহৎ সীমান্ত শার্শা বেনাপোল নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্ট রাজনীতির পটপরিবর্তনের পর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পার করে দেয়ার। একই সাথে অবৈধ এসব ঘাট দিয়ে চোরাই কারবারিও নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। যা বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি জেলা যুবদলের বহিস্কৃত প্রচার সম্পাদক এসকেন্দার আলী জনি ফেসবুকে লাইভে এসে অভিযোগ করেন। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা শহরে বিভিন্ন বাজার, মাছের ঘের ও বাওড় দখলে নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা। যা নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জেলা যুবদলের আহ্বায়ক এম তমাল আহমেদ বলেন, ‘রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর যুবদলের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মীকে শোকজ, বহিস্কার করা হয়েছে। সাথে সাথে হার্ডলাইনে গিয়ে বহিস্কার করায় এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তিনি বলেন, দেশ সংস্কারে, দেশ গঠনে কোন বিশৃঙ্খলা করলে অনেক ত্যাগী নির্যাতিত নেতাকেও বহিস্কার করা হয়েছে।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, ‘বিশৃঙ্খলাসহ নানা অভিযোগে দুই শতাধিক নেতাকর্মীর নামে অভিযোগ এসেছে। তার প্রেক্ষিতে আমরা দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিস্কার, শোকজ ও পদ স্থগিত রাখা হয়েছে। ৫ আগস্টের পরে দলের তরুণ নেতাকর্মীরা অনেকটা লাগামহীন হয়ে পড়েছিলো এটা সত্য। তারা বিশৃঙ্খলা করেছে, তারাই তো আওয়ামী লীগের দুশাসন দেখে বড় হয়েছে। তারা মনে করেছে, দখল, প্রতিশোধ এসবই মনে হয় রাজনীতি। পরে বহিস্কার, শোকজসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়াতে অনেকটা কমে এসেছে।’