বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা। জেলা শহরের পূর্বদিকের সড়কটি ধরে মিনিট পাঁচেক এগিয়ে গেলেই আরএন রোড। পুরো নাম যে রবীন্দ্রনাথ সড়ক, এটা প্রথমবার জানলে অবকা হওয়া কিছু থাকবে না। কোতোয়ালী থানা পেরিয়ে চৌরাস্তা মোড়ের পর থেকে শুরু হয়ে যা শেষ হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ সিনেমা হল মণিহার মোড়ে। প্রায় এক কিলোমিটার ধরে এই সড়কের দু’ ধারে যা দেখবেন সব পার্টস যন্ত্রাংশের দোকান। ছোট বড় এসব দোকানে মিলবে দেশে চাহিদার সব ধরনের পার্টস। তবে একটা সময়ে ক্রেতা, ব্যবসায়ীদের অর্ডারের চাপে দম ফেলার সুযোগ না থাকলেও এখন মোটামুটি চুপচাপ এখানকার ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বাচ্ছন্দ্যমত এলসি করতে না পারা ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসা এখন থমকে যাওয়ার উপক্রম।
চার দশকের বেশি সময় ধরে পার্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত যশোরের পরিচিত মুখ, সাংস্কৃতিকজন, কবি ও বিসমিল্লাহ অটোর কর্ণধার কাসেদুজ্জামান সেলিম। আরএন রোডের দোকানটিতে বিক্রয় কর্মীদের দেখা যায়নি তেমন একটা ব্যস্ততা।
দোকানভর্তি নানা ধরনের পার্টস। দোকান ছাড়িয়ে সেসব যন্ত্রাংশ রাখা হয়েছে ফুটপাতেও। তবে যাদের জন্য এমন পসরা, সেই ক্রেতা নেই আশানুরূপ। কাসেদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘সপ্তাহে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার ব্যবসা হতো তার। এখন সেটা নেমেছে দেড়, দুই লাখে। তিনি জানালেন, ‘স্বাচ্ছন্দ্যমত এলসি করতে পারছি না। মাঝে তো কয়েক বছর একেবারে বন্ধ ছিলো। এখন চালু হলেও সব ব্যাংক করতে পারছে না। এছাড়া পার্টস আমদানির বড় দেশে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হওয়াতে সেটা অনেকটা প্রভাব পড়েছে। চায়না থেকে আামদানি করতে গেলেও বন্দরে নানা হয়রানি, নানা জটিলতার কারণেও প্রভাব পড়েছে। তার পরেও আমরা বসে নেই, নতুন দিগন্তের দিকে ছুটছি। দিন দিন এখানে ব্যবসার বিস্তৃতি বাড়লেও ব্যবসা মন্দভাব।’
♦ শুরুর গল্প
বাংলাদেশের স্বাধীনতার এখানে টুকটাক করে শুরু হয় মোটর পার্টসের ব্যবসা। নব্বই দশকের পরে তা আরও বিস্মৃত হয়।
প্রথম দিকে ভারত থেকে অবৈধ উপায়ে বিভিন্ন পার্টস এনে ব্যবসা করতেন এখানকার বণিকেরা। চলতে চলতে ২০০০ সালের পর থেকে আরও বড় হয় ব্যবসা। আগে চিত্রা মোড়, চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড, নিউমার্কেট, রেলগেট এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটি দোকান থাকলেও আর এন রোডে বিংশ দশকের শুরুতে একসঙ্গে হতে শুরু করে দোকানগুলো। এরপর গত প্রায় ১৫ বছর ধরে মোটরসাইকেল, মোটরগাড়ি, কৃষি যন্ত্রাংশ, টায়ার-টিউবের জন্য দেশের অন্যতম বড় মোকামে পরিণত হয়েছে এলাকাটি।
আলম ট্রেডার্স, বিসমিল্লাহ অটো, লক্ষী অটো, শারাফাত মটর দিয়ে যে যাত্রা শুরু এখন সেখানে রয়েছে দুই হাজারেরও বেশি পার্টসের দোকান। প্রায় আড়াইশ আমদানিকারকের হাত ধরে ভারত, দুবাই এবং চীন থেকে আসে বিভিন্ন পার্টস। যার মধ্যে ভারত থেকেই আসে প্রায় ৮০ ভাগ। বছরে এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা এখানে হয় বলে জানান বাংলাদেশ মোটর পার্টস ও টায়ার-টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর অঞ্চলের সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু।
আর এন রোডে আবার ভাগ আছে। চৌরাস্তা থেকে শুরু বাই সাইকেলের পার্টস, এরপর কৃষি পার্টস, সবচেয়ে বড় অংশ মোটরসাইকেল পার্টসের। এরপর মোটর (বড় গাড়ি) পার্টস। আশেপাশের যত গলি আছে সেখানেও হয়েছে দোকান। আদতে ব্যবসায়ীরা দুই হাজার বললেও, এখানে কত দোকান আছে তার পরিসংখ্যান বের করা একটু কষ্টকর। আর এন রোড হয়ে, মণিহার মোড় পার হয়ে বকচর, মুড়লীর মোড়, রাজারহাট পর্যন্ত বিস্মৃত পার্টসের দোকানগুলো।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলারের পার্টস, বাস-ট্রাকের রিকন্ডিশন ইঞ্জিন ও বিভিন্ন ধরনের মোটর পার্টস আমদানি করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সারা দেশে মোটরসাইকেল পার্টস সরবরাহে এক নম্বর যশোর। রিকণ্ডিশন মোটর পার্টসের ক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রামের পর যশোরে অবস্থার। আর থ্রি ও ফোর হুইলারের ক্ষেত্রে চতুর্থ।
রোডের অন্যতম বড় আমদানিকারক স্বপ্ন অটোর কর্ণধান রাজু আহমেদ জানান-আগে যা ব্যবসা হতো তার ৬০ ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে নতুন পণ্য না আসায়। তিনি ৬০ জন কর্মচারির প্রায় ৭ লাখ টাকা মাসিক বেতন দেন। পুরো মার্কেটে রয়েছে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। এখন যে অবস্থা চলছে তাতে তার নিজের প্রতিষ্ঠানসহ মার্কেট জুড়েই সামনে হয়তো বড় ছাটাই শুরু হতে পারে বলে আশঙ্কা তার।
ইমন অটোর কর্মচারী ইউসুফ আলী বলেন, ‘সারাদেশের ব্যবসায়ী পাইকারি পণ্য নিতে যশোরে আসে। বেচাকেনায় মুখর থাকতো পুরো এলাকা। কিন্তু ইদানিং ব্যবসা খারাপ। অনলাইনেও অনেক ব্যবসা হয় বলে জানান তিনি। অনলাইনে কেউ অর্ডার দিলে পরিবহন ব্যবস্থা ভালো থাকাতে সহজে পণ্য পেতে বেগ পেতে হয় না বলে জানান এই কর্মচারি।’
সমিতির সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু বলেন, ‘ভারত ও চীনের মানসম্মত যন্ত্রাংশ সারাদেশে সরবরাহের কারণে খুবই দ্রুতই যশোরের মোটর পার্টস ও টায়ার টিউবের ব্যবসা জনপ্রিয়তা পায়। লাভজনক ব্যবসা করলেও এখন এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের ক্রান্তিকাল পার করছে। এলজি সংকটে নতুন করে পণ্য আসছে না। বাজারে যা আছে সব পুরনো পণ্য। তবে বিগত বছরের চেয়ে কিছুটা ব্যবসা হচ্ছে বলে জানান তিনি।’
♦ মোটর পার্টসের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণে নেই কর্তৃপক্ষ
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যশোরের পার্টসের বাজার আরো বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু এসব পার্টসের দাম ও মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে মানহীন পার্টস কিনে ভোক্তারা প্রতারিত হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। বাজারে মোটর পার্টসের দাম তদারকির জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক দামে বিক্রি করছেন এসব সরঞ্জাম। মোটর পার্টসের আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে গাড়ির যেসব পার্টস বিক্রি হচ্ছে তার প্রায় শতভাগই আমদানিকৃত।