# অংশ নেয় ছয় যুবক’
# তরিকুল হত্যা মামলায় যুবদলের দুই নেতাসহ আসামি ১১
# যুবদল নেতার নাম প্রত্যাহার দাবিতে বিক্ষোভ, থানা ঘেরাও
# বাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি ১০০-১৫০
হাসান আদিত্য
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সন্ধ্যায় যশোরের অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের বিল বোকড়ের আড়াইশ’ বিঘার একটি মাছের ঘের ইজারা চুক্তি করতে মোটরসাইকেলে ডহর মশিয়াহাটীর বাড়েদাপাড়ার পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে যান নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী সুমন। পিল্টুর বাড়িতে যাওয়ার পথে স্থানীয় মিষ্টির দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টিও নেন তারা। পিল্টুর বাড়িতে প্রবেশ করতেই তাদের দুজনকে ঘরের বারান্দায় চেয়ার টেবিলে বসতে দেয়া হয়। এরপর স্ত্রী, তরিকুল ও সুমনের উপস্থিতিতে ঘেরের চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন পিল্টু। এরপর তরিকুল স্বাক্ষর শেষ করে চুক্তিনামা চূড়ান্ত করেন। এর পরপরই তরিকুলের নিয়ে যাওয়া মিষ্টি একে অন্যকে খাওয়ানোর প্রস্তুতি চলছিল। এমন সময়ই উপস্থিত হন ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী ছয় যুবক। তাদের কারও পরনে থ্রি কোয়ার্টার, কেউ বা ফুল প্যান্ট পরা। যুবকদের মধ্যে একজন বাকি তরুণদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন; তোদের কি জন্য এনেছি এখানে! এর পরেই কেউ কোমর থেকে বের করেন পিস্তল, কেউ বা চাপাতি, রামদা, ছোরা, চাইনিজ কুড়াল।
কিছু বলার আগেই একজন তরিকুলের গলা জাপটে ধরে মাথায় তাক করেন পিস্তুল। এরপর টানতে টানতে নিয়ে যান পিল্টুর ঘরের ভিতর। এর পরেই দুর্বৃত্তদের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন সুমন।
ততক্ষণে পিল্টুর ঘরের ভিতরে তরিকুলকে মাথায়, পেটে ও ডান কনুইয়ের উপরে তিনটি গুলি করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দেহের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে ৩৫টি কোপ দিয়ে জখম করা হয়। ছয়জন মিলে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায় মাত্র পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যে। হত্যা নিশ্চিত করেই বীরধর্পে পায়ে হেঁটেই তারা চলে যান সুজাতপুরের দিকে। তরিকুলের সাথে থাকা উপজেলার ধোপাদি গ্রামের বাসিন্দা ও তরিকুলের বিশ্বস্ত সুমন (২৮) সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার এমন বর্ণনা দেন। একই বর্ণনা দিয়েছেন মামলার এজাহারের সাক্ষীতেও।
তরিকুল উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে। তিনি উপজেলার নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, নিজ ঘরে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটনার পরই মেয়ে-স্ত্রীকে নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান পিল্টু বিশ্বাস। হত্যার শিকার হওয়ার আগের দিনেও তরিকুল সুমনকে নিয়েই পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে যান। যেহেতু পাড়াটি একটি নির্জন বিলের মধ্যে। এজন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালাতে অসুবিধা হয়নি মিশনে অংশ নেয়া ছয় যুবকের।
তরিকুল যখন হত্যার শিকার তখন পাশের বাড়ির একটি ঘরে আশ্রয় নেন সুমন। সেখান থেকে গুলির শব্দ শুনে তরিকুলের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম টুলুকে ফোন দেন সুমন। ততক্ষণে পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে এসে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে তরিকুলের নিথর দেহ। পরে তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এলাকায় স্বনামধন্য ঘের ব্যবসায়ী ও কৃষকদল নেতার হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে ধোপাদি, আমডাঙ্গা থেকে আসা তরিকুলের সমর্থকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এরপর প্রথমে পিল্টুর বাড়ির দুটি ঘর ও রান্নাঘরে আগুন দেন।
এরপর পর্যায়ক্রমে একে একে ১৩টি পরিবারের ১৯টি ঘরে আগুন দেন তারা। আগুন দেয়ার আগে বাড়িতে অবস্থান করা সদস্যদের মারধর, লুটপাট করেন। ভয়ে আতংকে তারা পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের বিলে। এরপর দূর থেকে দেখতে পান তাদের বাড়ি ঘরে আগুন জ্বলছে। সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন ধানের গোলা, বসতঘর, রান্নাঘর, গোয়লঘর, টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ছাড়া উপজেলার সুন্দলী বাজারে দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। ঘটনার চারদিন পার হলেও এখনও বাড়িগুলোতে কোনো পুরুষ সদস্যকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে তারা অন্যত্র চলে গেছেন। কয়েকটি বাড়িতে কয়েকজন নারীকে পাওয়া গেল। তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক। মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে কয়েকদিন ধরেই পাড়াটির অর্ধশতাধিক মানুষ খোলা আকাশে নিচে বসাবস করছেন।
‘পরনের কাপড়ডা ছাড়া কিচ্ছু নেই’
গ্রামের কয়েকজন ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলছিলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়েদাপাড়ার মহিতোষ বিশ্বাসের বাড়িতে চলছিল মতুয়া সম্প্রদায়ের নামযজ্ঞের তোড়জোড়। আশপাশের গ্রাম থেকে সম্প্রদায়ের মানুষরা আসছিলেন এতে অংশ নিতে। গ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল। কেউ কেউ অনুষ্ঠানের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কেউ ছিলেন রান্নাবান্নার কাজে। তার মধ্যেই এই খুনের ঘটনা ঘটলেও প্রথমে কেউ কিছু বুঝতে পারেনি, বলেন গৃহবধূ পবিত্রা বিশ্বাস। তিনি বলেন, হঠাৎ একদল মানুষ বাড়ির মধ্যে ঢুকে শুরু করে তাণ্ডব। খাবারের ডেকচি উল্টে দিয়ে মারপিট করতে শুরু করে। তারপর আগুন দেয়া শুরু করে। তখন সবাই পালাতে শুরু করেন।
এ সময় জানা যায়, মহিতোষ বিশ্বাসের বাড়ির পিছনে মিন্টু বিশ্বাসের বাড়িতে তরিকুল খুন হয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এই তাণ্ডব চলেছে।’
গৃহবধূ পান্না বিশ্বাস বলেন, ‘ঘরে টিভি, ফ্রিজ, সোনাদানা, পাসপোর্ট, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, নগদ দেড় লাখ টাকা ছিল। এখন আর কিচ্ছু নেই। শুধু বাড়ির ছয়টি মানুষ বেঁচে আছি। পরনের কাপড়ডা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। রান্না করে যে খাবো, রান্না করার জিনিসপত্রও পুড়ে গেছে।’
হত্যার পেছনের কারণ:
স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জানান, স্থানীয় বিল কাছুরাবাদের বেশির ভাগ জমি ডহর মশিয়াহাটী গ্রামবাসীর। সেখানে একটি ঘেরের জমির ইজারার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মালিক ঘের ছেড়ে দিয়েছেন। এই ঘেরের জমি ইজারা নিয়ে তরিকুল ইসলাম মাছ চাষ করতে চেয়েছিলেন। অন্য আরেক ব্যক্তি ওই ঘেরের জমি ইজারা নিতে চাইলে দুজনের মধ্যে বিরোধ হয়। মূলত ৫ আগস্টের পর এই মাছের ঘেরকে কেন্দ্র করেই তরিকুলের প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। মূলত পিল্টু ঘেরটি তরিকুল ইসলামকে নিয়ে দিতে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। তাই বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেই ব্যক্তির লোকজন তরিকুল ইসলামকে ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টুর বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। নিহতের ভাই নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সহসভাপতি এবং সাবেক পৌর কাউন্সিলর জাকিরের দাবি, ‘ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘের লিজ দেয়ার নামে ডেকে নিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।’
# দুই যুবদলনেতাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা, নাম প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ, থানা ঘেরাও
তরিকুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর গত সোমবার রাতে নিহতের বড় ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু বাদী হয়ে দুই যুবদল নেতাসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন। এ ছাড়া অজ্ঞাত ২০ থেকে ২৫ জনকে মামলার আসামি করা হয়েছে। মামলায় রাজনৈতিক ও মাছের ঘেরের ইজারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে তরিকুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনায় অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের সাগর বিশ্বাস (২৭) এবং সদর উপজেলার রামনগর উপজেলার ফিরোজ খান (৩৫) আটক করেছে পুলিশ। এই মামলার বাকি ৯ আসামিরা হলেন হত্যাকাণ্ডের সংঘটিত হওয়া বাড়িটির মালিক ও মামলার প্রধান আসামি পিন্টু বিশ্বাস (৪৫)। এছাড়া মশিয়াহাটী গ্রামের দিনেশ (৩৫), দুর্জয় (২৫), অজিত (২৭), পল্লব (৩৫), গজো ওরফে পবন বিশ্বাস (২৮), অতীত মন্ডল (৪০), অভয়নগরের আকরাম আক্তার কোরাইশি পাপ্পু (৩৫), মাসুদ পারভেজ সাথী (৪০)।
কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলামের হত্যা মামলায় দুই যুবদল নেতার নাম থাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও থানা ঘেরাও করেছে উপজেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের এক অংশের নেতাকর্মীরা। সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার দুপুরে নওয়াপাড়া বাজার থেকে পৌর বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান জনির নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। পরে থানা ঘেরাও করে প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন। মামলার এজাহারে থাকা দুই আসামি যুবদলনেতা আকরাম আক্তার কোরাইশ পাপ্পু ও মাসুদ পারভেজ সাথীর নাম প্রত্যাহার করার দাবি জানান। আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে মামলা থেকে দুই নেতার নাম বাদ না দিলে অভয়নগরে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণাও দেন নেতৃবৃন্দ।
কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেয়া সম্প্রতি পৌর বিএনপির পদ স্থগিত হওয়া সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান জনি বলেন, ‘কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলাম ত্যাগি নেতা। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডে আমরা ব্যথিত। এমনকি হত্যার প্রতিবাদে ঘটনার দিন আমার নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল বের করি। সেই মিছিলে ছিলেন যুবদল নেতা আকরাম আক্তার কোরাইশ পাপ্পু ও মাসুদ পারভেজ সাথী। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই দুই নেতার নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত সেটা পরিস্কার। যেহেতু পাপ্পু ও সাথী আসন্ন উপজেলা ও পৌর যুবদলের সম্মেলনে সভাপতি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী বলেই বিএনপির একটি পক্ষ নিহতের ভাইদের প্রভাবিত করে এজাহারে নাম দিয়েছেন।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আলিম বলেন, ‘তরিকুল ইসলাম হত্যায় মামলা হয়েছে। মামলায় দুইজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
অপরদিকে, তরিকুল হত্যকাণ্ডের পর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের বাড়েদাপাড়ার হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় থানায় আরও একটি মামলা হয়েছে। ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের সুশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাস বাদী হয়ে একই দিন মামলাটি করেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ওসি আবদুল আলিম বলেন, ডহর মশিয়াহাটীর গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরও একটি মামলা হয়েছে। তবে এ মামলায় এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।