বাংলার ভোর ডেস্ক
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার হোতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহিন মিয়ার নাম বলেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির ভাষ্য, হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল। ভারতের কলকাতায় সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের মাস খানেক আগেই ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার বাসায় বসে খুনের ছক আঁটা হয় বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ। তিনি বলছেন, সংসদ সদস্যকে হত্যার পর শরীরের বিভিন্ন অংশ টুকরো করে হলুদ লাগিয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার কারণে লাশ উদ্ধার করা কঠিন।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, ঘটনা তদন্তে ভারতের আইনশৃঙ্খলা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। এরইমধ্যে ভারতের একটি তদন্ত দল ঢাকায় এসেছে। আনার খুনের ঘটনায় ডিবি হেফাজতে থাকা তিন সন্দেহভাজনকে ওই তদন্ত দল জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানান ডিএমপির ডিবি প্রধান। ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন।
এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার। হারুন অর রশীদ বলেন, ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন। তার সঙ্গে ছিলেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এক মাস আগে থেকে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসায় একাধিকবার বসে তারা এই হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়নি, ধরা পড়ার ভয়ে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা আবার চলে আসবে, সে মোতাবেক তারা কাজ করেছে।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী আমানুল্লাহর প্রকৃত নাম শিমুল জানিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, হত্যাকাণ্ডস্থলে ছিলেন আখতারুজ্জামান শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমান। আমানউল্লাহ, শিলাস্তি ও ফয়সাল নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। এর বাইরেও এ ঘটনায় ভারতীয় কিছু লোকজন টাকার বিনিময়ে হত্যাকারীদের জন্য কাজ করেন।
একদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী বলেছিলেন, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনস নামের বিলাসবহুল যে অ্যাপার্টমেন্টে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে, সেই বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান।
এই আখতারুজ্জামানের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে, এলাকায় তিনি শাহীন মিয়া নামে পরিচিত। তার ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান।
ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন বলছেন, তারা গুলশান ও বসুন্ধরায় মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীনের বাসায় বসে হত্যার পরিকল্পনা করলেও তারা এখানে এই হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে চায়নি। তাদের মনে ভয় ছিল- ঢাকার ডিবির সক্ষমতা নিয়ে; কারণ তারা জানে, ডিবি আগের হত্যাকাণ্ডগুলো কীভাবে উদ্ঘাটন করেছে।
হত্যা যেভাবে:
সংসদ সদস্য আনারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, পরিকল্পনা মোতাবেক তারা ২৫ এপ্রিল কলকাতার সেই বাসাটি ভাড়া করে। চুক্তি হয় তারা ৩০ এপ্রিল সেই বাসায় উঠবে। সেই মোতাবেক আখতারুজ্জামান শাহীন, আমানউল্লাহ ও শিলাস্তি ৩০ মে ঢাকা থেকে ফ্লাইটে কোলকাতা গিয়ে সেই বাসায় ওঠেন। তারা বোঝাতে চেয়েছিল যে এখানে পরিবার থাকবে। সেখানে গিয়ে তারা আরও দুজনকে হায়ার করে। এই বাসাতে আসা-যাওয়া করবে তারা। এর মধ্যে একজন জিহাদ অথবা জাহিদ, আরেকজন সিয়াম। আর মাস্টারমাইন্ড শাহীন কোন গাড়িটা- কোথায় ব্যবহার হবে, কাকে কতো টাকা দিতে হবে, কারা হত্যায় থাকবে- সবকিছু ঠিকঠাক করে ১০ মে বাংলাদেশে আসেন।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, দুই মাস ধরে তারা খেয়াল রাখছিল কোন সময় সংসদ সদস্য আনার কলকাতায় যাবেন, তিনি মাঝে মধ্যেই কলকাতা যান। গত ১২ মে কলকাতায় গিয়ে তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসায় ওঠেন এমপি আনার। তার আগে থেকেই শাহীনরা জানেন যে এমপি আনার ১২ তারিখ যাবেন। ১৩ মে এই চক্রটির ফয়সাল নামে এক ব্যক্তি একটি সাদা গাড়িতে এমপি আনারকে রিসিভ করে। কিছুদূর যাওয়ার পর তারা আরেকটি গাড়িতে ওঠে। সেই গাড়িতে এমপি আনার ও ফয়সাল ছাড়াও আমানউল্লাহ ছিলেন।
রাজা নামের একজন গাড়িটি চালাচ্ছিলেন জানিয়ে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, “ভারতীয় নাগরিক রাজা এসব কিছু জানে না, সে জাস্ট ক্যারিয়ার। ওই বাসার যাওয়ার পর আরেক ব্যক্তি মুস্তাফিজও সেই বাসায় ঢোকেন। ১৩ মে ২টা ৫১ মিনিটে তারা সবাই ঢুকেছে। আগে থেকেই ভেতরে ছিল জিহাদ ও সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যেই কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে। এবং তারা হত্যার এক ঘণ্টা পরে একজন- এমপি আনারের মোবাইলটা নিয়ে বের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় কল করেন; মানে বিভ্রান্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে।
লাশ সরানো হয় যেভাবে:
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল বিদেশের মাটিতে তারা হত্যা করবে এবং লাশটাকে এমনভাবে খুন করবে যাতে কেউ কোনোদিন না পায়। এরপর তারা লাশটাকে ছোট ছোট টুকরো করে ফেলেছে। হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলেছে। তারা ওই হাড়-মাংসগুলোর সঙ্গে হলুদ ও মসলা মিশিয়ে দিয়েছিল; যাতে পথে কেউ ধরলে- তারা বলতে পারে যে, এটা বাজার থেকে কেনা মাংস। উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবেই গুম করা হবে যাতে কেউ কোনোদিন তার কোনো অস্তিত্ব না পায়।”
ঘটনার বীভৎসতার বর্ণনা দিয়ে হারুন বলেন, ১৩ মে আমানউল্লাহ, জিহাদ ও সিয়াম দুটো স্যুটকেসে করে সেই দেহের টুকরোগুলো ভরে পাবলিক টয়লেটের সামনে দাঁড়ানো একটি গাড়িতে ওঠে। সেই গাড়ির ড্রাইভারও তেমন কিছু জানতো না। এরপর সিয়াম ও জিহাদকে স্যুটকেসসহ বিদায় করে আমানউল্লাহ আবার বাসায় চলে আসে। পরেরদিন আমানউল্লাহসহ পরের দুইজন বাকি মাংসগুলোকে পলিথিনে পেঁচিয়ে ব্যাগে ভরে তারাও বের হয়ে যায়।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, ১৫ মে আমানউল্লাহ ও শিলাস্তি রহমান বাংলাদেশে আসেন। ১৬ মে মুস্তাফিজ চলে আসে। ওরা সবাই যখন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে, তারপরে আখতারুজ্জামান শাহীন ভিসতারা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দিল্লি যান। সেখানে দুই ঘণ্টার বিরতি শেষে তিনি কাঠমান্ডুর ফ্লাইটে চাপেন। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে পারেন। যে সকল আসামিরা আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছে আমরা সব জেনেছি। তারা আমাদের কাছে সব স্বীকার করেছে। সেই বিষয়গুলো আমরা ভারতের তদন্ত সংস্থা ও পুলিশকে জানিয়েছি। তারাও কিছু কিছু উদ্ধার করেছে।
হত্যার কারণ কী:
কী কারণে সংসদ সদস্য আনার খুন হয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন বলেন, এটা যে কারণেই হোক, আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে সব বলতে পারব। এখন আমাদের কাজ আসামিদের গ্রেপ্তার করা।
ডিএমপির ডিবি প্রধান বলেন, মাস্টারমাইন্ডের ডাক নাম শাহীন, আসল নাম আখতারুজ্জামান। তার গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি। আর যে মূল কাজটা করেছে তার নাম আমানউল্লাহ (পাসপোর্ট অনুযায়ী)। কিন্তু তার আসল নাম আরেকটা, সে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে আমনউল্লাহ সেজেছে। সে গলাকাটা পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তার বিরুদ্ধে খুলনা, যশোর ওই এলাকাগুলোতে হত্যাসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এই আমানউল্লাহ ওরফে শিমুল হত্যাকান্ডের মূল সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে।
বুধবার সন্ধ্যায় আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে তার বাবাকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে আসামি হিসেবে সেখানে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি
লাশ না পেয়েও মামলায় হত্যার ধারা দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, “হত্যার মূল সমন্বয়কারী যে আমানউল্লাহ, তার কথা অনুযায়ী তো লাশ পাওয়ার কথা না। মাংস থেকে হাড় আলাদা করে হলুদের গুঁড়া দিয়ে তারা যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে।
দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, তারা ভিকটিমের মোবাইল থেকে বিভিন্ন সময় মেসেজ দিছে। কোনো সময় গোপাল বিশ্বাসের ফোনে রিং দিয়েছে, একটা মেসেজও পাঠিয়েছে যে, ‘আমি দিল্লি যাচ্ছি’। সেখানে তিনি অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করবেন। তারা পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে নিতে এই কাজ করেছে। কোনো সময় তারা মোবাইল নিয়ে গেছে বেনাপোল, কোনো সময় মোজাফ্ফরাবাদ। তার এপিএসসহ আরও অনেকের কাছে মেসেজ দেয়।
ঘটনাটি হানি ট্র্যাপ ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন বলেন, হানি ট্র্যাপ ছিল কি না, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে ঘটনাটি কি না কিংবা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এখানে আছে কি না; সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।