♦ প্রভাব পড়েছে বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব আহরণে
♦ ভারতীয় কোম্পানির ডিলারশিপ বাতিলের ঝুঁকি
♦ অনিশ্চয়তায় দোকান ও গুদাম ভাড়া এবং কর্মচারী বেতন
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
একের পর এক ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন যশোরের মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টস ব্যবসায়ীর। তাদের ব্যবসার খরচ বেড়ে চলেছে। এতে করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তারা। আমদানি খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে। এতে করে ভোক্তারা পার্টস কেনা কমিয়ে দেয়ায় মন্দা যাচ্ছে পার্টস ব্যবসার।
আবার ডলারের কারণে অনেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়েছে বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব আহরণের উপর। কেননা সিংহভাগ রাজস্ব আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চেচিস ও মোটরপার্টস আমদানি থেকে। মোটর পার্টসের আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি বছরের ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাস্টমসে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হয়েছে।
মোটরপার্টসের মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলেও শুল্ক-করে কোনো ছাড়ের উদ্যোগ নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্যবসার খরচ কমে, এমন কোনো উদ্যোগও সরকারের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। এমনিতে ব্যবসার খরচ আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়েছে। কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিসভাড়া ও অন্যান্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়বে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের দাম ভোগাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দাম ১১০ টাকা। তবে আমদানিকারকদের ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৩-১২৫ টাকায়। এতে পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের বড় বাজার রয়েছে যশোরে। এখানকার আমদানিকারকরা পার্টস আমদানি করে সারা দেশে বিক্রি করেন। প্রায় দুই হাজার দোকানির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে পার্টসখাতে। করোনাকালে এসব ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ ছিলেন চরম আর্থিক ঝুঁকিতে।
এখন ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারার কারণে ব্যবসা তলানীতে ঠেকেছে। আবার ভারতীয় কোম্পানির ডিলারশিপ বাতিলের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। কেননা পার্টস আমদানি করতে না পারলে তারা ঢাকার ব্যবসায়ীদের ডিলারশিপ দিয়ে দিতে পারেন। বর্তমানে পণ্য আমদানি করতে না পারায় অনেকে ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। ফলে অফিস, দোকান ও গুদাম ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দেয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের।
যশোর-খুলনা সড়কের ফারিয়া মোটরসের স্বত্ত্বাধিকারী ও আমদানিকারক মুরাদ আহমেদ জানান, করোনাকালে কোনো ব্যবসা হয়নি। কোনরকম টিকে আছি। পুঁজি ভেঙ্গে কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি। এখন এলসি করতে না পারার কারণে পণ্য আনতে পারছিনা। আবার ব্যাংক কোন ঋণ দিচ্ছেনা। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাবার কারণে আমাদের পণ্য আমদানিতে অনেক খরচ বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা খুব প্রয়োজন ছাড়া মাল কিনছেনা। সব মিলিয়ে দুর্দিনে আছি।’
মূলত থ্রি-হুইলার ও ফোর হুইলার পার্টস আমদানি করেন শহরের আরএন রোডস্থ নির্জন এন্টার প্রাইজের মালিক সোহেল রানা। তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রাহক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসে এসব পার্টস নিয়ে যান। কিন্তু গত একবছর ধরে এলসি বন্ধ থাকার কারণে মালামাল আনতে পারছিনা বললেই চলে। আবার ছোট আকারের এলসি মিললেও ডলারের মূল্য বেড়ে যাবার কারণে এখন পণ্য আমদানি করলে অনেক খরচ বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংকের ঋণের কিস্তি, দোকান ভাড়া-বাড়ি ভাড়া, কর্মচারির বেতন দিয়ে সংসার ও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চললে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে।’
বৃহৎ মোটরসাইকেল পাটর্স আমদানিকারক রিপন অটোস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এজাজ উদ্দিন টিপু জানান, ডলারের বিনিময়হার প্রতিনিয়িত বেড়েই চলেছে। আবার সরকার নির্ধারিত দামে ডলার মিলছেনা। এতে করে পণ্য আমদানি খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে বিক্রিতে। ক্রেতারা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে চায়না। আমাদের পার্টসখাতে সবারই ব্যবসায় মন্দাভাব যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমদানিকারকরা টিকতে পারছেনা।
আরেক বৃহৎ ব্যবসায়ী মদিনা অটোসের মালিক ফারুক হোসেন জানান, মোটরসাইকেল পার্টস আমদানি করি। এসব পার্টস সারা দেশে পাঠানো হয়। করোনায় পার্টস আমদানি করে বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তখন বিক্রি না হলেও ব্যাংকের সুদ ঠিকই দিতে হয়েছে আমাদের। এখন এলসি করতে না পেরে আরও বিপদে পড়েছি। ভারতীয় বড় কোম্পানিগুলো বলছে পণ্য নিতে না পারলে ব্যবসা ছেড়ে দাও। কোথায় গিয়ে ঠেকবে পরিস্থিতি বুঝতে পারছিনা।
বাংলাদেশ মোটরপার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর শাখার সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু জানান, যশোরে প্রায় দুই হাজার মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। যার বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণ। দুই হাজার দোকানে প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী রয়েছে। যাদের বেতন মাসে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এলসি করতে না পারার কারণে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছেনা। কিছু বড় ব্যবসায়ী পণ্য আনলেও ডলারের কারণে খরচ বাড়ছে তাদের। এতে সব ব্যবসায়ী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মন্দা ব্যবসা কারনে বহু পার্টস ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েছেন।
এদিকে বেনাপোল কাস্টমের রাজস্ব আহরণের সিংহভাগ আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চেসিজ ও মোটরপার্টস আমদানি থেকে। কিন্তু এলসি না হওয়ায় মোটর পার্টসের আমদানি কমে গেছে। চলতি বছরের ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাস্টমসে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। বেনাপোল কাস্টম অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে বেনাপোল দিয়ে মোটরপার্টস আমদানি হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, গাড়ির চেসিজ ও মোটরপার্টস আমদানি বেশি হলে রাজস্ব আহরণ বাড়ে। কম শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি হলে রাজস্ব কমবে এটা স্বাভাবিক। একবছর ধরে মোটরপার্টস আমদানি হচ্ছেনা বললেই চলে।
এ ব্যাপারে বেনাপোল কাস্টম হাউজের যুগ্ম কমিশনার শেফায়েত হোসেন জানান, এলসি না হাবার কারণে দেশের ব্যবসায় মন্দা থাকায় মোটরপার্টস আমদানি কমেছে। যে কারণে রাজস্ব আয়ও আমাদের কমেছে।