বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পতন হয়েছে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার। এই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন শত শত সাধারণ মানুষ। রক্ত ঝরেছে শত শত শিক্ষার্থীর। যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই বিজয় এসেছে তাদের যশোরের শিক্ষার্থীরা ভুলে যাননি। সড়কের পাশের দেয়ালে চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তাদের স্মৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বিবর্ণ অতীত মুছে দেয়ালে দেয়ালে স্বপ্নলিপি আঁকছেন তারা। শুধু তাই নয়, আন্দোলন চলাকালীন যেসব অশোভন ও রাজনৈতিক স্লোগান লিখেছিলেন, সেসব সাদা রং দিয়ে মুছে পুনরায় অনেক দেয়ালে নতুন করে লিখছেন দেশ সংস্কারের নানা স্লোগান ও বিভিন্ন শিল্পকর্মও আঁকছেন। শুক্রবার সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের এ চিত্রকর্ম করতে দেখা যায়। যশোরে বসাবসরত বিভিন্ন বয়সের স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ কর্মযজ্ঞে অংশ নেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সরকার পতন হয়েছে। নতুন করে দেশ গড়ার প্রত্যয় তরুণদের। পুরো দমে দেশ সংস্কার করতে হবে বলে মনে করেন তারা। গত কয়েকদিন দেশে যে সহিংসতা হয়েছে, তা ভুলে গিয়ে এগিয়ে যেতে চান। তাই কালো অতীত মুছে নতুন দিগন্ত লিখছেন তারা।
শুক্রবার সরেজমিনে শহরে ঘুরে দেখা যায়, যশোর শহরের স্টেডিয়াম এলাকা, পৌরপার্ক, পুরনো বই মার্কেট, জজকোর্ট মোড়, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সিভিল সার্জন অফিস, পৌর ফটক, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় সড়কের পাশে সব দেয়াল রং-তুলিতে শিক্ষার্থীরা রাঙিয়ে তুলছেন। সড়কের মাঝখানেও এঁকেছেন নানা আল্পনা। শিক্ষার্থীদের এমন শিল্পকর্ম নজর কেড়েছে সাধারণ পথচারীদের। অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন তাদের নানামুখী সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ। এর মধ্যে রয়েছে একতাই বল, বীর বাঙালির অহঙ্কার, বাংলাদেশের মানচিত্র, সংগ্রাম, ঐক্য, দুর্নীতি, প্রাণ প্রকৃতি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একাধিক মুহূর্তসহ নানা বিষয়।
দুপুর দেড়টার দিকে দেখা যায় যশোর পৌর পার্ক এলাকার দেয়ালে গোটা বিশেক শিক্ষার্থীরা শিল্পকর্ম আঁকছেন। কেউ রঙ গোলাচ্ছেন, কেউবা মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন আল্পনা এঁকে চলেছেন। একপাশে ক্লান্ত শরীরে কয়েকজন গোল হয়ে রুটি কলা বিস্কুট খাচ্ছেন। সরকারি মাইকলে মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাবাচ্ছুম ইসলাম সারা বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি হলো ছাত্র আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, রক্ত ঝরিয়েছে তাদেরকে ঘিরে। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনীতিক স্লোগান, কথাবার্তা এবং উসকানিমূলক বাক্য লেখা ছিলো। যা অশোভনীয়। তাই আমরা দলবদ্ধ হয়েছে দেয়াল রঙ করে, দেশের ঐতিহ্য, শহীদদের স্মৃতি ও আন্দোলনের স্মৃতি ফুঁটিয়ে তুলছি।
লাবণ্য নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে এই আন্দোলন করেছি। সাধারণ মানুষও যুক্ত হয়েছিলেন। শহরের দেয়ালগুলোতে নানা ধরনের লেখা ছিল, যা দৃষ্টিকটু ও সমীচীন নয়। তাই এসব লেখা মুছে নতুন করে রাঙানোর কাজ করছি। তুলে ধরছি আন্দোলনের নানা স্মৃতি। যাতে পথচলতি শিশু-কিশোর থেকে বয়স্ক-সবাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি ভুলে না যান, সে জন্য গ্রাফিতি আঁকছি।’
প্রায় ৩০ থেকে ৩০ জনের একটি দল যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছিলেন। তাদের মধ্যে মৌমিতা রায় নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আন্দোলন চলাকালীন এলোমেলোভাবে লেখা অনেক অশোভন ও রাজনৈতিক স্লোগান আমরা সাদা রং দিয়ে মুছে দিচ্ছি। স্বাধীন দেশে তা দেখতে ভালো দেখাচ্ছিল না। আবার সাদা দেয়ালটাও দেখতে ভালো দেখাবে না বলে সেখানে বিভিন্ন শিল্পকর্ম আঁকছি আমরা। পাশাপাশি দেশ সংস্কারের অভিনব সব স্লোগান লিখছি।’
শহরে মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীরা:
যেখানে-সেখানে থামতে পারছে না গাড়ি। দাঁড়াতে হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। উল্টো পথে চলার কোনো সুযোগ নেই। যেতে হচ্ছে নিয়ম মেনে। লাইন ভেঙে তাড়াহুড়ো করে সামনে যাওয়ার তাড়া নেই চালকদের। লেন মেনে চলছে ধীর ও দ্রুতগতির গাড়ি। পথচারীরাও রাস্তা পার হচ্ছেন শৃঙ্খলা মেনে। আর এসব কাজের তদারকি করছিলেন শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবকেরা। শুক্রবার দুপুরে এমন চিত্র দেখা গেল শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা, চিত্রামোড়ে। শহরের ব্যস্ততম মোড়গুলোর একটি। পুলিশ সদস্যদের কর্মবিরতির চারদিন ধরে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি নেই। এই অবস্থায় সড়কে যান চলাচলের ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আছে সাধারণ জনতাও। এছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ ভাংচুর হওয়া জায়গাতে পরিস্কার করার পাশাপাশি লিখন ও মোছার কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা।
ছাত্ররা ট্রাফিক পুলিশের চেয়েও কড়া:
শুক্রবার বেলা দুইটা। শ্রাবণের রৌদ্যজ্জ্বল দুপুরেও যেন চৈত্রের তেজ। এমনি পরিস্থিতি যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানাতে যানজটের চিত্র। নিয়ম ভেঙে উল্টো পথে যাচ্ছিলেন এক তরুণ মোটরসাইকেল চালক। বাঁশি বাঁজিয়ে হাতে বাঁশ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এক তরুণ। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় ওই চালককে বললেন, ‘সরি ভাইয়া, আপনাকে ইউটার্ন নিয়ে ঘুরে আসতে হবে।’ পরে ওই চালক নিয়ম মানতে বাধ্য হন। সেখানে ওই তরুণের মতো আরও ৩০ থেকে ৩৫ জন শিক্ষার্থী, স্কাউটস ও রোভার ও জনতা সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে দেখা যায়। সড়কের পাশে অযথা কোন যানবাইনকে দাঁড়িতে থাকতে দিচ্ছেন না। হেলমেট না ব্যবহারে কড়াকড়ি করছেন। কেউ কেউ প্রাইভেট মাইক্রো গাড়িও তল্লাশি করছেন। দড়াটানা মোড়ে পান বিক্রেতা আমজাদ মৃদু হেসে বলছিলেন, ‘সবাই সোজা হয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা ট্রাফিক পুলিশের চেয়ে কড়া। গাড়ি আটকালে আগে এমপি, নেতাদের বললে ছেড়ে দিতো। কিন্তু এরা শোনে না। যা নিয়ম তাই মানতে হচ্ছে। যার কারণে সবাই বাধ্য হয়ে আইন মোতাবেক সড়কে চলাচল করছে’। স্কাউটস সদস্য তাসনিমা সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা ট্রাফিক পুলিশ থেকে ভালো করছি। যানজট মুক্ত ও শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। প্রত্যাশা করছি সড়কে আগামীতে এ শৃঙ্খলা অব্যাহত থাকবে।’
##