♦রক্ষায় প্রয়োজন সংস্কার
শালিখা প্রতিনিধি
বন্যা, অপরিকল্পিত বাঁধ, দখলদারদের দখল, ময়লা-আর্বজনা, কচুরিপানা জমাসহ নানা কারণে নাব্যতা হারাচ্ছে মাগুরা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ১০টি নদ-নদী। এগুলো হলো ফটকী, বেগবতী, চিত্রা, নবগঙ্গা, গড়াই, কুমার নদ ও মধুমতি। একসময়কার খরস্রোতা ফটকী, বেগবতী ও চিত্রা নদীর এখন বেহাল দশা। সংস্কারের অভাবে এ নদীগুলি প্রায় মৃত প্রায়। সংস্কার হলে কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ রক্ষা পাবে ওই এলাকার জীববৈচিত্র।
ফটকী নদীটি ভারতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবাংলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে মাগুরা সদর ও শালিখা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ধনেশ্বরগাতী, সর্বসাংদা, দীঘলগ্রাম, ভাটোয়াইল, চুকিনগর, আড়পাড়া, শলই, বরইচারা হয়ে সোনাকুড়ে চিত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৯ কি.মি.। অপরদিকে, চিত্রা নদীটি চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে শালিখা উপজেলার দক্ষিণ সীমান্ত ও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে নড়াইল জেলা উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোপালগঞ্জে গেছে।
চল্লিশ বছর আগেও এ নদী দুটি ছিলো এই এলাকার গর্ব। এ নদীর উপর নির্ভর করে এলাকার ব্যবসা বানিজ্যের প্রসার ঘটেছিলো। এ নদীর জন্যই এককালে মাগুরা সদর উপজেলার মঘী ইউনিয়নের ভাবনহাটি বাজার, শালিখা উপজেলার শলই, সীমাখালী, খাজুরা, খানপুর, নারিকেলবাড়িয়া, হাজরাহাটি, বুনাগাতী, গড়েরহাট, পুলুম ও গঙ্গারামপুর বাজার ছিলো অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র। তৎকালীন সময়ে খুলনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় বড় পালতোলা নৌকা আসতো এ এলাকায় ধান, চাল, পাট, সরিষা, মুসুরি, পাট, আম, কাঁঠাল, বেল, খেজুর গুড়সহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য কিনতে। বর্তমানে নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় নদী সংযুক্ত প্রায় ৩০টি খাল ও ২০টি বিল এখন কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। নদীসহ এসব খাল বিলে পাওয়া যেতো বিভিন্ন প্রকার দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু সরপুঁটি, পুঁটি, ট্যাংরা, কৈ, শিং, মাগুর, রয়না, টেপা, পাবদা, চাঁদা, শৈল, ফলই, খয়রা, কাল বাউশ, রুই, চিতল, মৃগেল, আইড় ও বোয়ালসহ নানামাছ। এ নদী গুলোতে আগে ডলফিনও দেখা যেতো। যা এখন আর দেখা যায়না।
অন্যদিকে, ফটকী, বেগবতী, চিত্রা ও কুমার নদ সংস্কারের অভাবে বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়ে দুই পাড় ভেসে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও ঘর বাড়ি তলিয়ে যায়। ফলে প্রতিবছরই দু,পাড়ের মানুষদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। আবার শুস্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যায়। যার ফলে নৌ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সরকার নবগঙ্গা খননে ৪১ কোটি টাকার একনেকে প্রকল্প বরাদ্দ করলেও অন্য নদীগুলো খননের কোন ব্যবস্থা এখনও নেয়া হয়নি। এদিকে খাল খননে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও নদীগুলির তলদেশ ভরাট থাকায় তা কোন উপকারে আসছেনা।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, অনুমোদন হওয়া প্রকল্পের অর্থায়নে নদী খনন, বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় জনসাধারণের গোসলের জন্য ৮টি ঘাট নির্মাণ, পানি নিয়ন্ত্রণে শহরের ঢাকা রোডের নদীর উপর থাকা পুরাতন রেগুলেটর সংস্কার করা হবে। এ কাজ সম্পন্ন হলে নদীতে মাছ চাষ বৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ শুষ্ক মৌসুমে নানা কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে।
তাদের দেয়া তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে নবগঙ্গার উৎপত্তি। মাগুরা শ্রীপুর উপজেলার কুমার নদ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাগুরা পৌরসভার পারনান্দুয়ালী এলাকায় এসে নবগঙ্গা নাম ধারণ করেছে। ভারতের উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিত বাঁধ ও ব্রিজ নির্মাণ, পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে নদীটি। যে কারণে নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে চর। নদীর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের অর্থায়নে’ নদীটির ১১ কিলোমিটার এলাকা খননে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। যা সম্প্রতি অনুমোদন হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নদীর তলদেশে পলি জমে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাগুরা জেলার সদর উপজেলাধীন বড়বিলা বিল, কৈবিলা বিল, পুটুলিয়া বিল, রূপদাহ বিল, শালিখার চটার বিল, এলাকার জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে নবগঙ্গা নদী পুনঃখনন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। বর্তমানে প্রকল্পটি অনুমোদন পাওয়ার পর এ বছরেই নদী সংস্কারের কাজ দ্রুতই শুরু হতে যাচ্ছে।
মাগুরা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন বলেন, নবগঙ্গা নদী সংস্কার কাজ বাস্তবায়িত হওয়ায় তাতে জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশ রক্ষার কিছুটা লাঘব হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম চালানোসহ নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবন মানের উন্নয়নে অবদান রাখছে।