বিশেষ প্রতিনিধি
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের চার জেলার মধ্যে তিন জেলার সীমান্তে স্বর্ণ ও মুদ্রা
চোরাচালানে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের নামে হিস্যা তোলা হতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
অন্ধকার জগতে যা ‘আনার হিস্যা’ নামে পরিচিত ছিল। ওই সূত্রের দাবি যশোরের চৌগাছা, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও দর্শনা সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান করতে হলে আনারকে হিস্যা দিতে হতো। আর এই হিস্যা নিয়েই চোরাচালান গডফাদার সাথে আনারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর সেই দ্বন্দ্ব থেকেই আজ আনার গুমম বা হত্যার শিকার হয়েছে। পুলিশ ও একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্তসূত্র ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৫ বছর ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমের তিন সীমান্ত জেলা দিয়ে স্বর্ণ ও মুদ্রা চোরাচালানের প্রধান ছিলেন এমপি আনার। কিন্তু ২০১৮ সালে দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০২০ সালের প্রথম দিক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এমপি আনার। এতে করে চোরাচালান চক্রের অন্য গ্রুপগুলো তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে ধারণা সূত্রগুলোর।
স্থানীয় পুলিশ, বিজিবি ও অন্য সূত্রগুলো বলছে, মহেশপুরের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ১২ কিলোমিটার তারকাঁটাবিহীন। এই সীমান্ত দিয়ে বেশি চোরাচালান হয় দীর্ঘদিন ধরে। পাশাপাশি যশোরের চৌগাছা, ঢ়ুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও দর্শনা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ এবং মুদ্রা চোরাচালান হয়। এক্ষেত্রে পথ হিসেবে এমপি আনারের নিজের উপজেলা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জকে ব্যবহার করা হয়। এই উপজেলার উপর দিয়ে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর হয়ে যশোরের চৌগাছা ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ ও মুদ্রাসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালান করা হয়। ফলে কালীগঞ্জ উপজেলা চোরাচালানিদের জন্য যাতায়াতের অন্যতম পথ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, শাহীন ছাড়াও যশোরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী পলাতক আসামি বিদেশে অবস্থান করা সোনা চোরাচালানি, এ অঞ্চলের সাবেক এক সংসদ সদস্য, চুয়াডাঙ্গা এলাকার এক প্রভাবশালী মাড়োয়ারিসহ কয়েকজন চোরাচালানির কাছ থেকে এমপি আনার হিস্যা আদায় করতেন। ফলে এরা সবাই তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম সোনা আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হন, দর্শনার শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম সোনাগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল।
তিনি নিজেও সোনা চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
২০০৮ সালে ভোটে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পরের বছর ২০০৯ সালে আনার কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়লাভ করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সে সময় ইন্টারপোলের তালিকা থেকে তার নাম প্রত্যাহার হয়। পরে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
একাধিক সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে সীমান্ত দিয়ে অন্য যেসব সিন্ডিকেট সোনা চোরাচালান করতো তাদের সঙ্গে বিরোধ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সেই বিরোধের জেরেই আনারকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা।
আনার খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও অন্ধকার জগতের। খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আনারের বাল্যবন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন। তিনি নিজেও সোনা পাচারকারী একটি চক্রের প্রধান। আর খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন পেশাদার সন্ত্রাসী খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া।