রেহানা ফেরদৌসী
পাবনার ঈশ্বরদীতে সদ্যজাত আটটি কুকুর ছানা বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে মেরে ফেলার ঘটনা সারা দেশের মানুষকে হতবাক করেছে। সন্তান হারিয়ে মা কুকুরের ছোটাছুটি এবং আর্তনাদের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্যবার শেয়ার হয়েছে। গত রবিবার (১ ডিসেম্বর) আট কুকুর ছানা নিখোঁজের এই ঘটনাটি ঘটেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদ কোয়ার্টার কমপ্লেক্সের সামনে। এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি এবং কুকুরটি চিকিৎসাধীন রয়েছে । এই অমানবিক ও গর্হিত কাজের জন্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রাণি সম্পদ দপ্তর এর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে ‘অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার’ নামের একটি সংগঠনের সদস্যরা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। তবে এই ঘটনাটিই শুধু নয়, এ মাসের শুরুতেও বগুড়ায় একটি বিড়ালকে জবাই করে হত্যা ও পোড়ানোর ঘটনায় বেশ আলোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এর আগে, গত বছরের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আবাসিক এলাকা জাপান গার্ডেন সিটিতে পথ কুকুর বা বিড়ালকে বিষ প্রয়োগে মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। ওই সময় অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্তত দশটি কুকুর ও বিড়ালের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে মাঠে নামে প্রাণী অধিকার কর্মীরা। এর আগে, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চট্রগ্রামে বিষ প্রয়োগ করে শত শত কুকুরকে হত্যা করার অভিযোগ ছিল।
ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, মালিকবিহীন এসব পথকুকুর বা বিড়ালকে হত্যা, নির্যাতন বা আঘাত করলে আদৌ শাস্তির বিধান আছে কিনা? পথ কুকুরের নিরাপত্তা বা আইনি প্রতিকার সাধারণ ব্যক্তি নিজে চাইতে পারবে কি না? নাকি পুলিশই নিজে থেকে ব্যবস্থা নিতে পারবে? কে নেবে আইনি পদক্ষেপ?
গত ৪ নভেম্বর বগুড়ার দত্তবাড়িয়ার গুচ্ছ গ্রামে একটি বিড়ালকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন আদমদিঘী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। জিডিতে ঘটনার বিবরণে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি একটি সাদা-কালো রংয়ের পুরুষ বিড়ালকে তার নিজ বাড়িতে বটি দিয়ে গলা সম্পূর্ণ কেটে এবং বুক চিড়ে নাড়ি-ভুড়ি বের করে হত্যা করে পাশের ধানক্ষেতে ফেলে দিয়েছে। এই ঘটনা স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে সংগঠনটি জেনেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে জিডিতে।
এখন প্রশ্ন হলো,পথ বিড়াল বা কুকুরের হত্যার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি সরাসরি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন কি না! এমতাবস্থায় বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রাণি আইন যা আছে তা খুবই দুর্বল। এবং পথ প্রাণী হত্যা
এটি ধর্তব্যের বাইরে অপরাধ। এবং এই ঘটনায় দ্রুত কাউকে গ্রেফতার করা যাবে এমন বিধানই নেই।
আইন কী বলছে?
বাংলাদেশে প্রাণি নির্যাতন সম্পর্কিত প্রায় একশ বছরের পুরোনো ১৯২০ সালের ‘দ্য ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেলস অ্যাক্ট’ বাতিল করে ২০১৯ সালে প্রাণি কল্যাণ আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ প্রাণি কল্যাণ আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো আদালত মামলা গ্রহণ করবে না। অর্থাৎ, চাইলেই যে কোনো ব্যক্তি এই ধরনের অপরাধের জন্য আইনি প্রতিকার বা মামলা করতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগ ব্যতীত, কোনো আদালত এই আইনের অধীনকৃত কোনো অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করবে না। পাশাপাশি অধিদপ্তরের লোক ছাড়া কেউ মামলা করতে পারবেন না। মূলত প্রাণি কল্যাণ আইনের বাধা এখানে আর এ কারণেই গতবছরের মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটিতে ঘটনার এই আইনানুযায়ী মামলা করা যায়নি। এই কারণে ১৮৬০ সালের পেনাল কোড এর আওতায় সেসময় মামলা করা হয়েছিল। এই আইনের (পেনাল কোড) ৪২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি প্রাণি হত্যা করে বা ক্ষতি করে এবং যে কোনো প্রাণির মূল্য যদি ৫০ টাকা বা তার বেশি হয় তাহলে ওই ব্যক্তির পাঁচ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আবারও প্রশ্ন হলো, একটা রাস্তার কুকুর বা বিড়ালের মূল্য কিভাবে নির্ধারণ হবে? সেতো কারো মালিকানাধীন গবাদি পশু না। সেক্ষেত্রে এই ধারাও প্রমাণ করা কষ্টকর। ফলে এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে ২০১৯ সালের প্রাণি কল্যাণ আইন থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে। কেননা সেখানেই মালিকবিহীন প্রাণি হত্যা করা যাবে না সেটা বলা হয়েছে। তা বলছে ঠিকই কিন্তু প্রয়োগ আবার নাগরিকের কাছে দেয় নাই। প্রয়োগ আবার অধিদপ্তরের কাছে। ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার রিট আবেদনের প্রেক্ষাপটে কুকুর নিধন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলো আদালত। ঢাকার সিটি কর্পোরেশন ২০১৪ সালেই কুকুর নিধন কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে কুকুরকে ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ
নেয়। পরে ২০১৯ সালের নতুন প্রাণি কল্যাণ আইনে নিধন বা অপসারণ করা যাবে না বলে বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাণীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা, মারধর করা বা আঘাত করা একটি অপরাধ, যার জন্য প্রথমবার অপরাধ করলে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দণ্ডবিধির ৪২৯ ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর মূল্য ৫০ টাকা বা তার বেশি হলে এবং তাকে হত্যা বা ক্ষতি করা হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এছাড়াও কেউ কোনো প্রাণীকে এমনভাবে আটকে রাখা বা তা থেকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অন্যান্য বিধান
♦ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২ অনুযায়ী, বন্যপ্রাণী হত্যার জন্য এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান আছে।
♦ পোষা পাখি লালন-পালন, কেনা-বেচা, আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে লাইসেন্স না নিলে সর্বোচ্চ এক বছরের
কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। প্রাণি হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি কী?
প্রাণির প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ করা, সদয় আচরণ প্রদর্শন করার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের প্রাণি কল্যাণ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ অ-আমলযোগ্য এবং জামিনযোগ্য। পোষ্য এবং মালিকবিহীন দুই ক্যাটাগরিতে প্রাণিকে ভাগ করা হয়েছে এই আইনে। এই আইনে উল্লেখিত কোনো কারণ ব্যতীত মালিকবিহীন কোনো প্রাণিকে নিধন বা অপসারণ করা যাবে না। মালিকবিহীন কোনো প্রাণি, যেসব কুকুর বা বিড়াল পোষা নয়, এমন পথ কুকুর বা বিড়াল এমন প্রাণীকে কেউ যদি হত্যা করে তবে সেটা হবে অপরাধ, এই অপরাধে শাস্তির বিধানও আছে। প্রাণির প্রতি যেসব আচরণ নিষ্ঠুর হিসেবে বিবেচনা করা হবে তা হলো অঙ্গহানি করা এবং বিষ প্রয়োগে প্রাণি হত্যা। তবে যদি কোনো প্রাণি সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকলে বা অনিরাময়যোগ্য অসুস্থ হলে, তাকে বাঁচিয়ে রাখা নিষ্ঠুরতা বলে মনে হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতিক্রমে ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো যাবে। এছাড়া পোষ্য বা পথকুকুর বা বিড়ালকে হত্যা, নির্যাতন বা তার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করার আইনে সুযোগ নেই। এই আইনের অধীনে প্রাণির প্রতি যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর বিচার করতে পারবে ভ্রাম্যমাণ আদালত বা
মোবাইল কোর্টও। অর্থাৎ বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রাণি কল্যাণ আইন অনুযায়ী, প্রাণি হত্যার সর্বোচ্চ সাজা দুই বছর ।
ছোট ছোট সহিংসতাই সমাজের বড় বড় সহিংসতার জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে সহিংসতা আজ একটি নিত্যঘটনা। কিছু ক্ষেত্রে এ সহিংসতা হত্যা পর্যন্ত নিয়ে যায়। দুর্বলের ওপর দিয়ে সহিংসতা শুরু হয়। আর এ পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বল হলো প্রকৃতি এবং পশু, মানব শিশু, বৃদ্ধ মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ, প্রতিবন্ধী এবং পশুপাখি। এদেরকেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা সহ্য করতে হয়। এদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং মানবিক আচরণ দেখানো আমাদের সবার দায়িত্ব।
লেখক : সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)

