স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
সে এক অন্যরকম সময়। বর্ষা যখন আসে, প্রকৃতি যেন এক নতুন রূপে সেজে ওঠে। এ যেন নানান রঙে মোড়া স্বপ্নপুরী। ভরা আষাঢ়ে তাই যশোরের প্রাণ-প্রকৃতি যেন অনবদ্য এক ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে।
বর্ষার এই সময়টায় প্রকৃতি যেন তার সব সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে চারদিককে করে তুলেছে রঙিন। রুক্ষ মাটি সজীব হয়ে ওঠে বৃষ্টির ছোঁয়ায়। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, আর ফুলেরা যেন হাসে প্রাণ খুলে।
বর্ষায় পথে-ঘাটে, বাড়ির আঙিনায়, বিলের ধারে ফোটে নানা রঙের ফুল। কদম, শাপলা, জবা, নয়নতারা কত নাম বলব সেসব ফুলের! কদম ফুল তার মিষ্টি সুবাসে মন ভরিয়ে তোলে। বিলের পানিতে ফুটে থাকা সাদা আর লাল শাপলা চোখ জুড়িয়ে দেয়। আর এই ফুলের টানে ছুটে আসে নানা রঙের প্রজাপতি, মৌমাছি।
সকালের স্নিগ্ধ আলোয় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে। দোয়েল, কোকিল, টুনটুনি, শালিক সব যেন সুর ধরে বর্ষার আগমনী গানে। নতুন বাসা বাঁধে তারা, ডিম পাড়ে, আর তাদের ছানাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় গাছের ডালপালা। পানকৌড়ি, বক, ডাহুক নিত্যবেলা খাবারের খোঁজে উড়ে চলে পানিতে পূর্ণ নদী-খাল-বিলের ধারে। নদীগুলো বর্ষায় যেন নতুন জীবন পায়। ভৈরব, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা, চিত্রার জলস্তর বাড়ে, প্রবাহ হয় আরও জোরালো। নদীর দু’কুল ছাপিয়ে নতুন পানির ধারা উপচে পড়ে চারপাশের মাঠে, বিলের ধারে। অনেক সময় উপকূল প্লাবিত হয়ে ভেসে যায় ঘরবাড়িও।
নতুন পানিতে ভরে ওঠা গ্রামের বিলগুলো তখন শাপলা আর পদ্মে সমারোহে হয়ে ওঠে এক বিশাল রঙিন চাদর। জেলেরা ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে বের হন। এই সময়টায় দেশীয় মাছের প্রাচুর্য দেখা যায়। শিশুরা আনন্দে মেতে ওঠে জলকেলিতে, কিংবা কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেয় স্রোতের টানে।
বর্ষা শুধু প্রকৃতিকে সজীব করে তোলে না, মানুষের জীবনেও এর প্রভাব গভীর। কৃষকদের মুখে ফোটে হাসি। কারণ, এই বৃষ্টিই তাদের ফসলের জন্য আশীর্বাদ। আষাঢ়-শ্রাবণের এই সময়টায় আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়। মাঠে কৃষকদের ব্যস্ততা বাড়ে বহুগুণ।
এদিকে, শহুরে জীবনেও বর্ষার একটা আলাদা রূপ আছে। বৃষ্টি ভেজা দিনে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জানালার বাইরে বৃষ্টির ছটা দেখা, কিংবা পরিবারের সাথে আড্ডা সব মিলে এক অন্যরকম উষ্ণতা তৈরি হয়। মাঝে মাঝে লোডশেডিং হলেও, জোনাকির আলোয় বা মোমবাতির স্নিগ্ধ আভায় জমে ওঠে পারিবারিক গল্প।
বর্ষা যেমন প্রকৃতিকে নতুন জীবন দেয়, তেমনি মানুষের মনেও আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে আসে। বৃষ্টি ভেজা দিনের অলস দুপুর অথবা মেঘলা সন্ধ্যায় ইলিশ ভাজার গন্ধ, খিচুড়ির আয়োজন এ যেন এক চিরাচরিত বাঙালি ছবি। কর্মজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও, বর্ষার এই সতেজতা মানুষের মনে এক নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। তাইত মানুষ বর্ষাকে বরণ করে নেয় সাদরে। এই সময়ে উৎসবের আমেজও থাকে। পিঠা-পুলির আয়োজন অনেক ঘরেই। বৃষ্টির দিনগুলো হয়ে ওঠে স্মৃতিময়।
বর্ষা শুধু একটি ঋতু নয়। এটি আমাদের জীবন, আমাদের প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ষার এই অপরূপ রূপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির সাথে আমাদের গভীর বন্ধনের কথা। এই সময়ে গ্রাম-শহর-নগর যেন হয়ে ওঠে এক সবুজে মোড়া কবিতা।
এ বিষয়ে কবি ও সাহিত্যিক কাজী নূর বলেন, বর্ষা মানেই প্রেম। বর্ষায় প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যে প্রেমের বন্ধন তৈরি হয়। নব নব সাজে প্রকৃতি মানুষের স্মৃতিপটে জাগিয়ে তোলে হারানো দিনের কথা। বর্ষার সাথে নদীর জোয়ার, কদম ফুলের শুভাস, চিংড়ি-পুঁটির ঝোলে গরম ভাত। কলা বা কচুপাতা মাথায় দিয়ে ঘরে ফেরার স্মৃতি প্রত্যেকটা মানুষের সুখময় সোনালী অতীত।