# আমদানি রপ্তানি স্বাভাবিক
# সীমান্তে বিজেপির সভা, আতঙ্ক
হাসান আদিত্য
দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি রপ্তানি স্বাভাবিক থাকলেও কমেছে যাত্রী পারাপার। সোমবার ভারতের পেট্টাপোল এলাকায় বিজেপির শীর্ষ স্থানীয় এক নেতা রাজনীতিক কর্মসূচিতে আমদানি রপ্তানি বন্ধের হুংকার দেয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর মুক্তির দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপির সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী সমাবেশে বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের পরিষেবা বন্ধের হুমকি দেন। এতে দিনভর গুজব ছিল বাণিজ্য ও যাত্রীসেবা বন্ধের। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকেই দুদেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানি স্বাভাবিক থাকলেও অর্ধেকে নেমেছে যাত্রী পারাপার। যারা যাওয়া আসা করছেন তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে শঙ্কা-সংশয়।
ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে ভারত থেকে ফেরেন হীরালাল দাস। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা শহরের বাসিন্দা তিনি। বেনাপোলে ফিরে হীরালাল দাস বলেন, ‘সোমবার ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে শুনে কোনো কিছু কেনাকাটা না করেই ফিরে এসেছি। জিনিসপত্র নিয়ে প্রবেশ করতে দেবে কি না, এই আশঙ্কায় পরনের পোশাক ছাড়া ব্যাগে কিছুই নিয়ে আসিনি। ১০ দিন আগে কলকাতার বারাসাতে আত্মীয়বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার দিনে বেনাপোল বন্দরে উপচেপড়া ভিড় ছিল। ইমিগ্রেশন করতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে পেট্রাপোল ও বেনাপোলে ইমিগ্রেশন শেষ হয়েছে। যাত্রীর চাপ একদমই নেই বললে চলে।’
বেনাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের অফিসার ইনচার্জ ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভুঁইয়া জানান, ‘সোমবার ভারতে গেছে এক হাজার ৯৮২ জন পার্সপোটবাহী যাত্রী। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এক হাজার ৯ শ’৪২ জন। আর মঙ্গলবার বেলা দুইটা পর্যন্ত ভারতে যায় ৭৭৫ জন। আর ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৭৬৯ জন। যা স্বাভাবিক সময়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার যাত্রী দৈনিক যাওয়া আসা করে।
তিনি বলেন, ‘নতুন করে ভিসা না দেয়া ও বাংলাদেশে মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যাত্রীেেদ আগ্রহ কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই মাসের পর থেকে ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণের ভ্রমণ ভিসা দেওয়া বন্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকে যাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষের ভিসার মেয়াদ রয়েছে। এর পর থেকে দুই দেশের মধ্যে গমনাগমন আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেনাপোল বন্দরের ইমিগ্রেশন আন্তর্জাতিক যাত্রী টার্মিনালে অনেকটা ফাঁকা। আগে যেখানে ভারতে প্রবেশের আগে পার্সপোট ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্রের যাচাই-বাছাই করতে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ করতে হতো। এদিন কোন রকম অপেক্ষা না করেই দ্রুত সময়ে ভারতে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। ইমিগ্রেশন কেন্দ্রগুলোতেও কোন ভিড় দেখা যায়নি। দু-একজন করে যারা আসছেন; দ্রুত প্রক্রিয়া শেষ করে নিদিষ্ট গন্তব্য যাচ্ছেন।
ভারতের বারাসাত থেকে ভ্রমণ শেষে বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে ফেরেন অরবিন্দ দাস। কুমিল্লা শহরের বাসিন্দার ভাষ্য, ‘কোন ভিড় নেই। ১০ মিনিটে পেট্টাপোল ইমিগ্রেশন থেকে বেনাপোল ইমিগ্রেশন শেষ করে যাত্রী টার্মিনালে এসেছি। অথচ ১৫ দিন আগে বেনাপোল বন্দর থেকে পেট্টাপোলে যেতে দুই ঘন্টার বেশি সময় লেগেছিলো। তিনি বলেন, ‘আতঙ্কের কারণে অনেক বাংলাদেশি আছেন যারা চেকপোস্ট বন্ধের খবর শুনে দেশে ফিরছেন। তবে আমরা স্বাভাবিক দেখলাম দু স্থানেই। তবে মানুষের ভিতর এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে।’
ভারতফেরত পাসপোর্টধারী শাহাবুদ্দীন জানান, ‘ভারতের কিছু মানুষ পশ্চিমবঙ্গের বনগা শহরে মাইকিং করে বাংলাদেশিদের হোটেলে থাকা বন্ধ করতে মালিকদের চাপ প্রয়োগ করেছে। এতে সাধারণ বাংলাদেশিদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়ালে অনেকে দেশে ফিরে আসছেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বাধা সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে পাসপোর্টধারীরা সেখানে অবস্থানে সহযোগিতা পেয়েছেন।’
# সীমান্তে বিজেপির সভা, আতঙ্ক
বেনাপোল বন্দরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল সীমান্তে দেশটির কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এ সময় পেট্রাপোল শূন্যরেখার ওপারে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দলটির নেতা-কর্মীরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। তখন দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রী গমনাগমন বন্ধ ছিল। এক ঘণ্টা পর তাঁরা বিক্ষোভ শেষ করলে আবার আমদানি-রপ্তানি ও যাত্রী গমনাগমন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের প্রভাবে মঙ্গলবার যাত্রী গমনাগমন ও পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কিছুটা কমেছে।
বেনাপোল স্থল বন্দরের একটি সূত্র জানিয়েছে, চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বাংলাদেশের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধে স্থলবন্দর পেট্রাপোলের কাছে সভা করেছে বিজেপি। সীমান্তে অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে চেয়েছিল বিজেপি। তবে সীমান্তরক্ষী বিএসএফ ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় তাদের এ পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে সীমান্তের কাছে প্যান্ডেল করে সভা করে বিজেপি। সেখানে বক্তব্য দেন পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী। যা বেনাপোল স্থলবন্দরের শূণ্য রেখা থেকে দেখা গেছে। স্থলবন্দরের কর্মকর্তা ও ভারতগামী যাত্রীরা শূণ্য রেখার আশেপাশে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখতে থাকলে বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে।
বেনাপোল ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বেলা একটা পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষ যাতায়াত করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছেন ৭৭৫ জন এবং ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন ৭৬৯ জন। সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত যাত্রী আসা-যাওয়া হলেও মূলত বেলা দুইটা পর্যন্ত যাত্রীর চাপ বেশি থাকে। সে অনুযায়ী সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও ৩০০ থেকে ৪০০ যাত্রী যাতায়াত করতে পারেন বলে পুলিশ জানায়। সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দেশের মধ্যে প্রায় চার হাজার যাত্রী যাতায়াত করেছেন। যদিও ৫ আগস্টের আগে এই সংখ্যা ছিল প্রতিদিন সাত থেকে আট হাজারের মতো।
# আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক
বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে দু’ দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। পণ্য নিয়ে আসছেন ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভাররা। বাংলাদেশ থেকে পণ্য খালি করে যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে ভারতে যেতে দেখা গেছে। সোলাইমান শেখ নামে এক ভারতীয় ট্রাক ড্রাইভার বলেন, ‘আগের থেকে বর্ডার একটু কড়া। তবে মালামাল রপ্তানিতে আমাদের কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি কেউ। স্বাভাবিক সময়ের মতো পেট্রাপোল বন্দরে পণ্য খালি করে ফিরে এসেছেন। সেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা একটু জোরদার করা হয়েছে।’
বেনাপোল স্থল বন্দরের উপ পরিচালক (ট্রাফিক) রাশেদুল সজিব নাজির জানান, ‘আমদানি রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। সোমবার ২০১ ট্রাক পণ্যবাহী ট্রাক রপ্তানি হয়। আমদানি হয় ২৪৩ ট্রাক। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১০৫ ট্রাক আমদানি হয়েছে। রপ্তানি ১০০ ট্রাক। দুদেশের এমন পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে আমদানি রপ্তানির প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন।’