বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনে যশোরের মণিরামপুরে চেয়ারম্যান পদে সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু ও কেশবপুরে মফিজুর রহমান বিজয়ী হয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের আশির্বাদ ছাড়াই স্রোতের বিপরীতে ভোটে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন তারা। দুজনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বদলে গেছে স্থানীয় রাজনীতির দৃশ্যপট। তাদের বিজয় ঘিরে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
বুধবার রাতে নিজ নিজ উপজেলা পরিষদে ফলাফল গণনা শেষে রিটার্নিং অফিসার ফলাফল ঘোষণা করেন। মণিরাপুরে আনারস প্রতীকে ৬ হাজার ৫শ’ ৫৫ ভোটের ব্যবধানে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন আমজাদ হোসেন লাভলু। তার প্রাপ্ত ভোট ৫৯ হাজার ২শ’ ৭৩। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন পেয়েছেন ৫২ হাজার ৭শ’ ১৮ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে সন্দীপ ঘোষ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পুনরায় কাজী জলি আক্তার বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
অন্যদিকে, কেশবপুর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান ১৭ হাজার ২শ’ ১১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছে। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি নাসিমা সাদেক পেয়েছেন ১২ হাজার ৮শ’ ৯৩ ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছে আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রাবেয়া ইকবাল। এর আগে, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। দুই উপজেলায় ইভিএমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
লাভলুর জয়ে বদলে গেল রাজনৈতিক দৃশ্যপট
স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পরাজিত হওয়াতে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে নেতাকর্মীরা পরাজিত হওয়াতে নানা কারণ খুঁজতে চেষ্টা করছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মণিরামপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত যশোর-৫ সংসদীয় আসন। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে তৎকালীন এমপি ও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এসএম ইয়াকুব আলী। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই পরাজিত হওয়ার সেই আলোচনা বেশ ডালপালা মেলে। পরাজিত হওয়ার পর নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে উপজেলা পরিষদ কাছে পেতে মরিয়া ওঠেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টচার্য্য। আর নিজেদের উপজেলা ধরে রাখতে চেষ্টা অব্যাহত রাখে বর্তমান এমপি ইয়াকুব।
তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই শীর্ষ নেতা দুটি প্যানেল ঘোষণা করেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু। তার প্রতিদ্বন্দ্বি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন। লাভলু সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্যরে পক্ষের এবং প্রভাষক ফারুক এমপি এসএম ইয়াকুব আলীর পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত। তাদের প্রার্থিতার বিষয়ে সাবেক ও বর্তমান দুই এমপির দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে কোনো ঘোষণাও তারা দেননি। তবে, মণিরামপুর উপজেলার মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয় লাভলু স্বপন ভট্টাচার্য্যরে এবং ফারুক ইয়াকুব আলীর সমর্থন নিয়েই ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু ফারুককে এমপি ইয়াকুব সমর্থন দেয়াতে ক্ষুব্ধ হয়ে এমপির আরেক অনুসারী সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিকাইলও নির্বাচনে নামেন।
এতে ইয়াকুব আলী শিবির অস্বস্তিত্বে পড়ে। একই গ্রুপে দুই প্রার্থী থাকাতে বিজয়ী হওয়া নিয়ে শঙ্কা জাগে। শেষ মেষ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও ইয়াকুব আলীর নির্দেশে মিকাইল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এতে অবস্থান শক্ত হয় ইয়াকুব আলীর। কিন্তু প্রভাষক ফারুক দলের সেক্রেটারি হলেও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো কম। অন্যদিকে লাভলু সাবেক চেয়ারম্যান থাকায় উপজেলাতে তার আলাদা পরিচিতি রয়েছে। একই সাথে প্রতিমন্ত্রী অনুসারীদের সাপোর্ট পাওয়াতে তার বিজয়ী হতে কষ্ট হয়নি। অন্যদিকে ফারুককে এমপির মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করাতে মেনে নিতে পারেনি স্থানীয় প্রয়াত এমপি খান টিপু সুলতান ও মিকাইল গ্রুপ। ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকেই ভোটের মাঠে আসেননি। কেউ কেউ আসলেও ভোট করেছেন লাভলুর পক্ষে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ফারুক পরাজিত হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে এমপির মনোনীত প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যর্থতা। মিকাইলকে মনোনীত না করাতে আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে ভোটে আসেনি। কাক্সিক্ষত ভোট কাস্ট না হওয়াতে ফারুক পরাজিত হয়েছেন।
আনারস মার্কায় বিজয়ী চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে সকল আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগের সকল শ্রেণীর নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। ইতিপূর্বে দু’বার জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছি। সেই বিশ^াস ও ভালোবাসা নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলাম, যার জন্য ভোটাররা আমাকে জয়ী করেছেন।
মফিজ কেন জিতলেন
কেশবপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সাতজন। এই উপজেলাতে বিজয়ী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান মফিজ। স্থানীয় ভোটাররা জানান, গত সংসদ নির্বাচনে হারানো জমিন ফিরে পেতে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাজী মুজাহিদুল ইসলাম পান্নার প্রতি আশির্বাদ ছিল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের। অন্যদিকে, নাসিমা আক্তার সাদেক প্রচার করেছেন বর্তমান এমপি আজিজুর রহমান তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। যদিও এসব ব্যাপারে সাবেক ও বর্তমান এমপি প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা দেননি। তারপরও উপজেলাব্যাপি বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারণায় ছিলো।
কেশবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহবায়ক ও বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মফিজুর রহমান মফিজ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে বিভিন্ন সময় কেশবপুরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সাথে সাথে নেতাদের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের সময়ে তার রাজনৈতিক প্রসার বাড়ে। এর পর শাহীন চাকলাদারের সাথে সক্ষতার কারণে ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারক বনে যান। একদিকে কেশবপুরের প্রভাবশালী নেতাদের সংঘবদ্ধচক্রের অন্যতম সদস্য মফিজ অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণে গড়ে তোলেন ঘেরের ব্যবসা। কেশবপুর -যশোর মহাসড়কের পাশে মধ্যকুল এলাকায় তার কয়েক শত বিঘার ঘের কিছুদিন আগে হাতবদল হয়েছে। প্রভাবশালী এই নেতা রাজনীতি ও ঘের ব্যবসা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সেই সঞ্চিত অর্থের বন্টন করেছেন কতিপয় নেতা কর্মী ও ভোটার সমর্থকদের মাঝে। একাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থী গণমাধ্যমকর্মীদের ভোট শুরু থেকে কালো টাকার ছড়াছড়ি হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন।