বাংলার ভোর প্রতিবেদক
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর যশোর অঞ্চলের মানুষের জন্য একদিকে স্বজন বিয়োগ যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস আর অন্যদিকে মুক্তির আনন্দ-উদ্বেল-উচ্ছ্বাসের দিন। নবজন্মের সেই মুহূর্তকে তাঁরা বরণ করে নিয়েছিলেন হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য দিয়ে। বধ্যভূমির উপর উড়িয়ে দিয়েছিলেন রক্ত পতাকা যুদ্ধের ঠিক ২৪৫ দিনের মাথায়। এত মিছিল, এত প্রাণের স্পন্দন আর যশোরে দেখা মেলেনি। মৃত্যুর অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে ও অসংখ্য লাশের স্তুপ সরিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন হাজার হাজার বাঙালি। কেননা এদিন ভোরে যশোর জেলা হয়েছিল হানাদার মুক্ত। দেশের প্রথম মুক্ত জেলা হবার গৌরব অর্জন করেছিল যশোর। তাই ৬ ডিসেম্বর যশোরবাসীর অহংকার। আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের দৃপ্ত শপথও। এদিনটিকে যশোরবাসী উদযাপন করে ‘যশোর মুক্ত দিবস’ হিসেবে।
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, যশোর মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আজ ৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় ঐতিহাসিক টাউন হল ময়দান থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন মনি, বীরমুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলমসহ কয়েকজনের ভাষ্যমতে, অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে তখন ভাসছে দেশ। এমনি একটি দিন ৩ মার্চ ১৯৭১। এদিনই যশোরের কালেক্টরেটের সামনে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। হানাদার মুক্ত করার শপথ নেন যশোরবাসী। এরপর বের হয় জঙ্গি মিছিল। শহিদ সড়কে (তৎকালীন কেশবলাল রোড) এলে পাক বাহিনী গুলি চালায় মিছিলে। শহীদ হন চারুবালা ধর। তাঁর মরদেহ নিয়েও জঙ্গি মিছিল করেন মুক্তিকামী জনতা। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে গঠিত হয় সশস্ত্র গ্রুপ। শহরের ভোলা ট্যাংক রোডে তৎকালীন ইপিআর দফতরে প্রশিক্ষণ চলে ছাত্র-জনতার। প্রতিদিনই শহরে বের হতে থাকে জঙ্গি মিছিল। ২৬ মার্চ রাতে পাকবাহিনী যশোর শহরে আকস্মিক হামলা চালায়। তারা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতা তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য মশিয়ুর রহমানকে। পাশবিক উল্লাসে পাক বাহিনী তাঁকে সেনানিবাসে নিয়ে হত্যা করে। শহিদ এ নেতার লাশের সন্ধান আর মেলেনি। এর আগে ২৩ মার্চ যশোর কালেক্টরেট প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুঁচকাওয়াজ। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য গঠিত ওই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্য ছিলেন ছাত্র-জনতা। এ সময় মেয়েরাও রাস্তায় নামেন। ২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী যশোর শহর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। শহরের পুরো নিয়ন্ত্রণ আসে সংগ্রাম পরিষদের হাতে। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে যশোর পর্যন্ত পদযাত্রা করে ১৫ হাজার মুক্তিকামী জনতার এক সশস্ত্র মিছিল। যশোরবাসীর সহযোগিতায় মিছিলকারীরা হামলা করেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্ত করা হয় সকল রাজবন্দীকে। ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বঙ্গ শার্দুলরা বিদ্রোহ করেন। নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দীন। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ৪ এপ্রিল শহীদ হন লে. আনোয়ার হোসেনসহ আরও অনেকে। কুমিল্লার শাহরাস্তির সন্তান আনোয়ারের বীরত্ত-গাঁথা আজও মুখে মুখে ফেরে। তিনি শুয়ে আছেন যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের বারীনগর কাজী নজরুল ইসলাম কলেজের পাশে। এদিন পাকবাহিনী ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, কামানসহ যশোর শহরে হামলা চালায়।
অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। নিরস্ত্র জনতাকে বাড়ি থেকে বের করে এনে হত্যা করে পাকবাহিনী। শান্ত ভৈরব নদীর পানি রক্তে লাল হয়। পুরো শহরই পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। জুলাই মাস পর্যন্ত হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর লাগামহীন তাণ্ডব চলতে থাকে। ওই মাসেই শুরু হয় প্রত্যাঘাতের পালা। উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করে যশোর শহরে। হানাদাররা এ সময় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে থাকে। সশস্ত্র দখলদার বাহিনীর সদস্যদের যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়ে তাদের ঘাঁটির মধ্যেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৮ নম্বর রণাঙ্গনের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মঞ্জুর। যশোর সেনানিবাসে হানাদার বাহিনীর ১০৭ নম্বর বিগ্রেড মোতায়েন ছিল। এর কমান্ডার ছিল বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো ৬টি বৃহত্তর জেলা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর হামলা রুখতে হানাদাররা যশোর সেনানিবাসের চারদিকে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে। মজুদ করে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ। মেজর জেনারেল নিয়াজি বলত ‘যশোর সেনানিবাস হচ্ছে প্রাচ্যর লেলিনগ্রাড’। আর এর প্রতিরক্ষা ব্যুহ হচ্ছে ‘ম্যাজিনোলাইন’। এদিকে ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী উত্তর চব্বিশ পরগনার বয়রা সীমান্ত পথে যশোর সেনানিবাস দখলের অভিযান শুরু করে। ছুটিপুর থেকে শুরু হয় সেনানিবাসে কামানের গোলা নিক্ষেপ। যশোর সেনানিবাসকে ঘেরাও করতে বয়রা-কাবিলপুর-গরীবপুর হয়ে এগোতে থাকে ট্যাংক বাহিনী। ২২ নভেম্বর দখলদার বাহিনীর অগ্রবর্তী ঘাঁটি চৌগাছার পতন ঘটে। সেনানিবাস পুরোপুরি মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর কামানোর আওতায় আসে। হানাদার বাহিনী তাদের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি তৈরি করে যশোর চৌগাছা সড়কের সলুয়াতে। এ সময়ই প্রাণভয়ে বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান তার বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার যশোর থেকে খুলনায় স্থানান্তর করে। ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেন যশোর সেনানিবাস।
সেনানিবাস দখলের শেষ অভিযান শুরু হয় ৪ ও ৫ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্ত অবাক হন তারা। আগেই প্রাণভয়ে সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে শুরু করে পাক বাহিনী। তাদের একটি অংশ পালিয়ে যায় খাজুরা দিয়ে মাগুরার দিকে। অন্য অংশটি খুলনার দিকে। ৬ ডিসেম্বর ভোরে মিত্র বাহিনীর ট্যাংক রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। যশোর শহরে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বেশষ পতাকা উড়েছিল ৪ এপ্রিল। পাক বাহিনী ওই দিনই সব পতাকা নামিয়ে দিয়েছিল। ঠিক তার ২৪৫ দিনের মাথায় ৬ ডিসেম্বর আবার স্বাধীন বাংলাদেশের পাতাকা উড্ডীন হয়। হানাদার মুক্ত হয় প্রথম জেলা হিসেবে যশোর।