বাংলার ভোর প্রতিবেদক
নব্বই দশকের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সংশয় ছিলো। প্রথাগত ঐতিহাসিকদের কাছে বদ্ধমূল ধারণা ছিলো ভূমি গঠন নবীন হওয়ায় এই অঞ্চলে আদি ঐতিহাসিক যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মণিরামপুরের ধনপোতা ঢিবি, দমদম পীরস্থান ঢিবি, ডালিঝাড়া প্রত্মস্থল খননের পর সেখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও নিদর্শন প্রাপ্তির ঘটনা প্রথাগত ঐতিহাসিকদের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে। প্রত্মস্থল সম্পর্কে আরও জানার অভিপ্রায়ে মঙ্গলবার থেকে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামের ধনপোতা ঢিবিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধান অতিথি হিসেবে খনন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিশাত তামান্না। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এ-ই প্রত্নঢিবিটি ২০০৭ সালে চিহ্নিত করা হয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকে প্রথম প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় এই প্রত্নঢিবিতে উতখনন কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত অর্থ বছরে ১১ টি বর্গে হ্যারিস ম্যাট্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাচীন স্থাপনার ধবংসাবশেষ উন্মোচনসহ খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু সমূহ নথিভুক্ত করণ করা হয়। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রত্ন ঢিবির সীমিত একটি অংশে খনন পরিচালনা করে প্রাচীন ইট নির্মিত চতুষ্কোণ প্রার্থনা কক্ষ সমেত একটি বর্গাকার স্থাপনার সন্ধান পাওয়া যায়। উন্মোচিত স্থাপনাটিকে প্রাথমিক ভাবে আদি মধ্যযুগের কোন স্থাপত্য নিদর্শনের বলে ধারণা করা হয়। কোন প্রামাণ্য ঐতিহাসিক উপাদান (শিলালিপি, মুদ্রা বা স্মারক নিদর্শন পাওয়া না যাওয়ায় স্থাপত্য কাঠামোর ব্যবহারিক উদ্দেশ্য, প্রকৃতি এবং ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামে চারদিকে ধূ-ধূ মাঠ। মাঠের মাঝখানে সুউচ্চ একটি ঢিবি। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এটি পরিচিত ধনপোতা ঢিবি/ বিরাট রাজার ঢিবি /ধনপতি সওদাগরের বাড়ি নামেও পরিচিত। প্রাচীন এই ঢিবিকে কেন্দ্র করে শতশত বছর ধরে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে নানা জনশ্রুতি। জনশ্রুতির কাহিনীর সাথে মহাভারতের পৌরানিক কাহিনীর মধ্যেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মহাভারতের ‘বিরাট পর্বে উল্লেখ আছে, পঞ্চপাণ্ডব বনবাস থেকে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খেদাপাড়ার ধনপোতা ঢিবিকে কেউ কেউ মহাভারতের কাহিনীতে উল্লেখিত বিরাট রাজার বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ বলেও মনে করেন। এই ঢিবির নিচেই বিলুপ্ত আছে ‘বিরাট রাজা’ নামের হাজার বছরের পুরনো এক রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। যার নীচে বিলুপ্ত রয়েছে বিপুল পরিমাণ গুপ্তধন রয়েছে। গুপ্তধন পুতে রাখা আছে এমন জনপ্রবাদ থেকে ঢিবির নামকরণ করা হয়েছে ধনপোতা ঢিবি। ‘মহাভারত’-এর বিরাট পর্বে শকুনি মামার চক্রান্তে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার শর্তানুযায়ী পঞ্চপাণ্ড ১২ বছর অজ্ঞাত বনবাস শেষে যে স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই স্থানের সাথে কথিত খেদাপাড়ার বিরাট রাজার কাহিনীর সাথে অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায।
নাম-পরিচয় গোপন করে পঞ্চপাণ্ডব ও তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদী স্বরূপনদীর তীরে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রত্নসূত্রের ভিত্তিতে যশোরের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে আমাদের প্রথম ধারণা প্রদান করেন বরেণ্য প্রত্নতত্ত্ববিদ কে এন দীক্ষিত। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বরেণ্য এই প্রত্নতত্ত্ববিদ যশোরের ভরত ভায়না/ জটার দেউল বা ভরত রাজার দেউল পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করে ঢিবির নিচে বিলুপ্ত প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্বের কথা প্রথম জানান। কে এন দীক্ষিতের এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যশোরের প্রাচীনত্ব ঐতিহাসিকদের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনে সাহায্য করে। এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার দমদম পীরস্থান ঢিবি, কেশবপুর উপজেলার গৌরিঘোনা ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে ডালিঝাড়া প্রত্নস্থানে খননের ফলে বাংলাদেশের আদি ঐতিহাসিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবিতে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রম পরিচালনার ফলে গুররুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর প্রত্নসাক্ষ্যসহ বিভিন্ন ধরণের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।