স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
বৈশাখের তপ্ত গরমে যশোরে চলছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় চুয়াডাঙ্গাকে ছাড়িয়েছে যশোর, পারদ উঠেছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বাতাসের আদ্রতা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। প্রচণ্ড তাপমাত্রায় বাতাসে যেন আগুনের হল্কার আঁচ মিলছে। যা চলতি মৌসুমের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে শনিবার। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় যশোরের জনজীবনে ত্রাহি অবস্থা। ঝিকরগাছায় হিট স্ট্রোকে এক নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সারাদেশের মত যশোরেও হিট এলার্ট জারি করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসচেতনতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, শনিবার যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বাতাসে আদ্রতা ছিল ২৫ শতাংশ। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার আগের দিন বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৭ এপ্রিল ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৬ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা মোড় থেকে শুরু করে সিভিল কোর্টের মোড় হয়ে চাঁচড়া চেকপোস্ট হাইওয়ে পর্যন্ত পুরো আড়াই কিলোমিটার সড়কে শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিনই তীব্র যানজট লেগে থাকে। শহরের প্রবেশপথ এ সড়ক দিয়ে মানুষজন বিভিন্ন অফিস-আদালত, হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজে যাতায়াত করে। ফলে মানুষের উপস্থিতি এবং যানবাহনের চলাচল সব থেকে বেশি থাকে সড়কটিতে। তবে শনিবার সড়কটির চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। তীব্র তাপদাহে জনশূন্য হয়ে পড়ে পুরো সড়কটি। মানুষের উপস্থিতি যেমন কম, তেমনি যানবাহনের উপস্থিতিও ছিল নগণ্য। শুধু মুজিব সড়কই নয়, শহরের বড়বাজার সংলগ্ন দড়াটানা মোড়, বকুলতলা, গরিব শাহ সড়ক, জেল রোডসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছে। এ সকল সড়কেও নেই যানবাহনের উপস্থিতি। দু-একটা ইজিবাইক, রিকশা দেখা গেলেও যাত্রীর অপেক্ষায় মোড়ে মোড়ে বসে থাকতে দেখা গেছে চালকদের।
শহরের জিরো পয়েন্টে রাস্তার ওপর রিকশা রেখে জজ কোর্টের প্রাচীরের গায়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন রিকশাচালক জমির হোসেন। তিনি বলেন, ‘বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহর পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। এত গরমে মানুষ বের হবে কী করে? পেটের দায়ে বের হয়ে যাত্রী পাচ্ছি না। ভাড়ার রিকশা চালাই, মহাজনকে দেয়ার মতো টাকা এখনও ওঠেনি। নিজের জন্যে তো দূরের কথা।’
বায়েজিদ হোসেন নামে ভ্রাম্যমাণ দোকানে লেবুর শরবত বিক্রি করা দোকানি বলেন, গরম ভালোই পড়ছে। গরমে শরবত বিক্রি বেড়েছে। লেবুর শরবত ১০ থেকে ২০ টাকা প্রতি গ্লাস বিক্রি করছি।
ইউসুফ নামে একজন পথচারী বলেন, চৌগাছা থেকে জরুরি কাজে শহরে এসেছি। গরমে শরীরের পানি শূন্যতা পূরণ করতে আখের রস খাচ্ছি। কাজের ফাঁকে কালেক্টরেট অফিসের সামনে গাছের ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।
প্রচণ্ড তাপমাত্রায় যশোরের মানুষ একটু স্বস্তির জন্য মানুষ গাছের ছায়ায় বসছেন। কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিরাও গলা সমান পানি নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। চরম বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষেরা। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায় এই গরমে তাদের ঘরে বসে থাকার মত অবস্থা নেয়। বাধ্য হয়ে রিকসা, ভ্যান, ইজিবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে উত্তপ্ত রাস্তায়। ভোর বেলা থেকে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পরা দিন মজুর মানুষেরা একবেলা কামলা খেটে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবীদেরও নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা হওয়ার মত। প্রচণ্ড গরমে একটু মানসিক শান্তি পেতে অনেকেই পানি জাতীয় খাবার যেমন তরমুজ আনারস, বাঙ্গি, পেঁপে, পেঁয়ারা, কলা কিনে খাচ্ছেন। রাস্তার পাশে গড়ে উঠা ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে উপড়ে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। ঘর থেকে কাজের প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ ঠান্ডা লেবুর শরবত, আঁখের রস পান করে সাময়িক সময়ের জন্য গরম নিবারণ করাসহ শরীরের পানি শূন্যতা পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফার্মেসিসহ দোকানে দোকানে বেড়েছে স্যালাইন ও ঠান্ডা বিক্রির হিড়িক। প্রচন্ড তাপদাহে যশোর জেলা প্রশাসনসহ স্বাস্থ্য বিভাগ সর্বসাধারণকে সতর্ক করছেন। তারা মাইকিং ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া, ঢিলে ঢালা সুতি পোষাক পরা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের শরবত এগিয়ে চলা, এসি বা ইয়ারকুলার ব্যবহারে সতর্ক হওয়া, বয়স্ক ও শিশুদের বিশেষ যত্ন নেয়াসহ বেশি অসুস্থতাবোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জোর তাগিদ দিচ্ছেন। এদিকে প্রচণ্ড গরমে কারণে হিট স্ট্রোক হওয়ার আশংকা বেড়ে যাচ্ছে। শনিবার দুপুরে হিট স্ট্রোক জনিত কারণে ঝিকরগাছার সীমা খাতুন নামে এক নারী যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। হিট স্ট্রোক থেকে রেহায় পেতে উচ্চ রক্তচাপ থাকা মানুষদের রৌদ্রতাপ, ধুমপান, অ্যালকোহল সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
অন্যদিকে, ধারাবাহিক তাপপ্রবাহের কারণে যশোরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে না। সারাদেশে ৭ দিনের পাঠদান কার্যক্রম স্থগিত করায় অভিভাবদের উৎকন্ঠা দূর হয়েছে। প্রচণ্ড তাপে বয়স্ক ও শিশুরা ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও এর মাত্রা অত্যধিক না। তারপরও সকলকে সতর্ক থাকতে স্বাস্থ্য বিভাগ আহবান করছেন।
তাপপ্রবাহে যশোরের অধিকাংশ টিউবওয়েলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। অকেজো হয়ে পড়ে আছে হাজার হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ। কৃষকদের কৃষি কাজে পানির ব্যবহারে বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। সড়কের বিটুমিন গলে পথচারিদের চলাচলের ভোগান্তি বাড়ছে। এদিকে পৌরসভাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মশার উপদ্রব্য বাড়ছে। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড গরমে বিষিয়ে উঠেছে এ জেলার জনজীবন।
যশোর মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ডা. আলাউদ্দিন আল মামুন বলেন, ‘এই সময়ে ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, পক্স, হিটস্ট্রোক, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি হতে পারে। প্রচণ্ড গরম থেকে মুক্তি পেতে কেউ যেন ডিপ ফ্রিজের পানি পান না করেন। এ সময় প্রচুর পানি, ডাবের পানি, দেশি ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন।’ দিনমজুর বিশেষ করে কৃষকরা যেন বেলা ১১টার মধ্যে এবং বিকালে তাপমাত্রা কমলে কাজ করেন সেই পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সোলজার রহমান বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ দায়ি। যশোর অঞ্চলে অবাধে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। রাস্তা সম্প্রসারণের নামে সম্প্রতি ৮শ’ হেক্টর বনভূমি অবাধে বিনষ্ট করা হয়েছে। এসি বা এয়ারকুলারের ব্যবহার দিনদিন বাড়ছে। যার প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নও তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই ধারা থেকে মুক্তি পেতে বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ করতে হবে। জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
##