বাংলার ভোর প্রতিবেদক
ভিন্ন এক বাস্তবতায় যশোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৯তম শাহাদৎ বার্ষিকী পালন করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শহরের বকুলতলাস্থ শেখ মুজিবর রহমানের ক্ষতবিক্ষত ম্যুরালে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তারা। নেতাকর্মীরা জানান, জেলা আওয়ামী ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর ব্যানারে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও উপস্থিত ছিলেন না সংগঠনগুলোর শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতাকর্মীরা। সংগঠনগুলোর কয়েকজন পদ-পদবীধারি নেতাদের নিয়ে ম্যুরাল প্রাঙ্গনে উপস্থিত ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে দ্রুত কর্মসূচি শেষ করেন তারা। দেশের সর্ববৃহৎ শেখ মুজিবর রহমানের ম্যুরালটি এভাবে ক্ষতবিক্ষত দেখে উপস্থিত নেতাকর্মীরা আবেগে আপ্লত হয়ে পড়েন। একই সাথে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
এদিকে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কর্মসূচি শেষে চলে যাওয়ার পরে শ্রদ্ধা জানানো বেদিতে রাখা ফুলের ডালি নিয়ে ভাংচুর তছনছ করেছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে ঘিরে ম্যুরাল প্রাঙ্গন বা শহরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের অবস্থান করতেও দেখা যায়নি। তবে শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে শহরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা।
১৯৭৫ সালের এই দিনে এক দল বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবার হত্যা করে। সরকারে আওয়ামী লীগ থাকাকালে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করত। সচরাচর এই দিনে ভোর থেকেই যশোরের মোড়ে মোড়ে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বারবার মাইকে বাজানো হতো। দলীয় নেতা-কর্মীসহ অন্যরা কালো ব্যাজ ধারণ করতেন। শহরের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর এসব ম্যুরাল ভরে থাকত ফুলে ফুলে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ ছাড়া বেদিতে ফুল দেয়নি, তেমনই বাজেনি বঙ্গবন্ধুর কোনো ভাষণও।
নেতাকর্মীরা জানান, সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ‘জাতীয় শোক দিবস’এর ছুটি বাতিল ও বিরোধী পক্ষের সম্ভাব্য বাধার মুখে ভিন্ন এক বাস্তবতায় ১৫ অগাস্ট পালনে প্রস্তুতি নেয় যশোর জেলা আওয়ামী লীগ। সংগঠনটি ও সহযোগী সংগঠনগুলো শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতারা আত্মগোপনে থাকাতে কর্মীদেরকে দিবসটি পালনে আহ্বান জানানানো হয়। ১৩ আগস্ট গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম তরফদারে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন ও শহরের গাড়িখানাস্থ দলীয় কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়। সেই কর্মসূচির অংশ হিসাবে বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টার দিকে শহরের বকুলতলাস্থ বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে দু এক জন করে উপস্থিত হতে দেখা যায়। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হায়দার গনি খান পলাশ, অ্যাডভোকেট আলী রায়হানসহ জেলা আওয়ামী লীগের ছয়জন, পৌর আওয়ামী লীগ, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগ, যুবদলের সর্বমোট ২৫ থেকে ৩০ জন উপস্থিত হয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কর্মসূচি শেষ করে তারা ম্যুরাল প্রাঙ্গন ত্যাগ করেন। ছিলেন না সংগঠনগুলো সভাপতি-সম্পাদকসহ প্রভাবশালী পদ-পদবীধারী নেতাকর্মীরা। দলীয় কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্ট সকল শহীদদের দোয়া ও আলোচনা সভার কর্মসূচি থাকলেও নেতাকর্মীদের নিরাপত্তার আতঙ্ক কর্মসূচি বাতিল করা হয়।
নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের কর্মসূচি শেষ করার পরেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকমীরা মিছিল নিয়ে ম্যুরাল প্রাঙ্গনে আসেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা এসে শ্রদ্ধা জানানো ফুলের ঢালি ভাংচুর করেছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলা শাখার প্রধান সমন্বয়ক রাশেদ খান বলেন, ‘আজ আমাদের কোন কর্মসূচি ছিলো না। কেউ যদি ভেঙ্গে থাকে তারা তাহলে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ভাঙ্গার পক্ষে না গড়ার পক্ষে।’
নেতাকর্মীরা জানান, দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা বকুলতলা চত্ত্বরে নির্মিত এ ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ম্যুরাল’। ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ম্যুরাল স্থাপনে ব্যয় হয়েছে ২৯ লাখ ৯ হাজার ৯৫ টাকা। এ সম্পূর্ণ টাকা যশোরের ব্যবসায়ী মহল ও সাধারণ মানুষরে অনুদান থেকে সংগৃহীত। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের কয়েক ঘণ্টা পর ম্যুরালটি ভাংচুর করা হয়। ম্যুরালের মুখমন্ডল পুরোটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে না ম্যুরালটি আসলে কার। ম্যুরালে বঙ্গবন্ধুর মুখমন্ডলের স্থানে সাঁটানো হয় আল্লাহু লেখা ব্যানার। ম্যুরালের চারিপাশে লোহার গ্রিল থাকলেও সেগুলো লুট করেছে দুবৃর্ত্তরা।
জেলা আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক অহিদুল ইসলাম তরফদার বলেন, ‘যশোর জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা রাজনৈতিক এই পরিস্থিতির কারণে প্রকাশ্যে না আসতে পারলেও তাদের নির্দেশে কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু অনেকেই পরিস্থিতির কারণে আসতে পারেনি। সীমিত পরিসরে নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে যায়। শ্রদ্ধা জানানোর পরে আমাদের ফুলের ডালিও ভাংচুর করা হয়েছে। দোয়া মাহফিলের আয়োজন থাকলেও সেটাও করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীরা যে যেভাবে পেরেছে কর্মসূচি পালন করেছে। তিনি বলেন, ‘সরকার পতনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাংচুর করা হলেও বঙ্গবন্ধুর চেতনা আদর্শ দেশে থেকে মুছে দেয়া যাবে না। যারা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাংচুর করেছে তাদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে, থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে শহরের চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ডে পুরাতন কসবা আওয়ামী লীগ পরিবারের ব্যানারে খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পথচারী, হতদরিদ্র রিকসা ইজিবাইক চালকদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক শেখ আতিকুর বাবু, আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম আহমেদ, মারুফ হোসেন খোকন, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জ্যোৎস্না আরা মিলি, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মঈউদ্দিন মিঠু প্রমুখ। এছাড়া, এদিন নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে গণভোজের খিচুড়ির হাড়িও ভাংচুর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
##