♦চালক খুনেও পিছপা হচ্ছে না ছিনতাইকারীরা
♦উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো
♦সড়কে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ সচেতন মহলের
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
চলতি বছরের ১১ আগস্ট। যশোরের অভয়নগর উপজেলার শংকরপাশা গ্রামের সোনাচুনি বিলের মধ্যে একটি গাছের সঙ্গে গলায় কাপড় প্যাঁচানো অবস্থায় লিমন শেখ (২৫) নামে এক ভ্যানচালকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি উপজেলার বুইকারা গ্রামের কাসেম শেখের ছেলে। শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও তিনি ইঞ্জিনচালিত ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। ঘটনার একদিন পরে নিহতের পরিবার মামলা করলেও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে এই হত্যার রহস্য। ঘটনার ৮ দিন পর আটক করা হয় হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা বিল্লাল হোসেনকে।
পুলিশ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ যাওয়ার পরিকল্পনা করে আসছিলেন উপজেলার শংকরপাশা গ্রামের বিল্লাল হোসেন।
বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে ভ্যান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন তিনি। এরপর ১১ আগস্ট রাত ১০টার দিকে নূরবাগ এলাকা থেকে দুই শ টাকায় লিমনের ভ্যান ভাড়া করেন তিনি। এরপর ভৈরব সেতু পার হয়ে শংকরপাশা গ্রামে নাসির ফারাজীর বাগানের কাছে পৌঁছলে ভ্যানচালক লিমনকে মারপিট শুরু করেন। পরে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে ভ্যানটি নিয়ে বিল্লাল পালিয়ে যান। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আলোচিত হওয়ায় পুলিশ নড়েচড়ে বসলে হত্যার প্রমাণ ঢাকতে লিমনের ভ্যানের চারটি ব্যাটারি খোলার পর নিজ বসতঘরের মেঝে খুঁড়ে ভ্যানটি মাটিচাপা দিয়ে রাখেন বিল্লাল। পরে বিল্লালের বিক্রি করা ভ্যানের ব্যাটারির সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করে পুলিশ।
শুধু এই ঘটনা নয়; ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যশোরে ৫টি হত্যাকান্ড ঘটেছে ইজিবাইক ও অটোভ্যান ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য। এর মধ্যে একটি অটোভ্যান ও চারটি ইজিবাইক চালক ছিলেন। সব কয়েকটি ঘটনায় মামলার পরে আসামিদের আটক করেছে পুলিশ। তবে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা এসব পরিবারগুলো। এছাড়া অগণিত রয়েছে অটোরিকসা বা ইজিবাইক চুরির ঘটনা। এসব ছিনতাইয়ের শিকার অনেকেই আবার ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন ইজিবাইক-অটোভ্যান। ফলে পরিবারগুলোকে স্বজন হারানোর শোকের সঙ্গে বয়ে বেড়াতে হয়েছে ঋণের বোঝাও। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলছে, মূলত অর্থনৈতিক কারণে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। ইজিবাইকের প্রতিটি যন্ত্রাংশ আলাদাভাবে খুব সহজেই বিক্রি করা যায় বলেই ছিনতাইয়ে আগ্রহ বেশি ছিনতাইকারীদের। এ অবস্থায় সড়কে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সচেতন মহল।
অভয়নগরে নিহত লিমনের বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার তিন ছেলে। লিমনই আমার আর আমার স্ত্রীকে দেখতো। একটা এনজিও থেকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে তারে একটা ভ্যান কিনে দিছিলাম। বস্তিতে একটা বাড়িতে ভাড়া থাকি।
শারীরিকভাবে অসুস্থ তাই বিয়েও দেয়নি। যা আয়রোজগার করতো সেটা দিয়েই আমাদের তিন জনের চলে যেত। তিনি বলেন, আমার আরো দুই ছেলে থাকলেও তাদের অবস্থাও খারাপ। আমার পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে খুব কষ্টে আছি। একদিনে সংসার চলে না, আবার কিস্তির মাধ্যমে ভ্যান কেনার টাকাও পরিশোধ হয়নি। যে আমার ছেলেডারে এইভাবে খুন করেছে, তার বিচার দ্রুত বিচার দেখতে চাই।’
গেল বছরের ৫ আগস্ট ভোররাতে ভাড়ায় যেয়ে হত্যার শিকার হন কেশবপুরের সোহাগ হোসেন বায়োজিদ। নিহতের হাবিবুর শেখ বলেন, ‘আমার ছেলেটা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। গাড়ি (ইজিবাইক) চালিয়ে যে টাকা পেতো তা দিয়েই তার সংসার ও আমার সংসার চালাতো। ছেলেটাকে মেরে ফেলার পর থেকে অনেক কষ্টে চলছি এখন। একটা গাড়ি (ইজিবাইক) ছিনতাই করার জন্য জলজ্যান্ত মানুষকেই মেরে ফেললো! পুতা ছেলের চার বছর বয়স; তাকে নিয়েও চিন্তায় আছি। ছেলের বউডাও অন্য জায়গায় কাজ করে। আমিও বৃদ্ধ বয়সে কাজ করে সংসার চালাতে হয়। এখনও কিস্তির টাকায় কেনা ইজিবাইকের কিস্তি দিয়ে যেতে হচ্ছে।’
যশোর অটোভ্যান, রিকসা ও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য মতে, যশোরে ভ্যান রিকসা ও ইজিবাইক রয়েছে ২৫ হাজারের বেশি। অধিকাংশ কিস্তির মাধ্যম কেনা। ইজিবাইক দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা। অটোভ্যান ৪০ থেকে ৫০ আর রিকসা ৮০ থেকে এক লক্ষা টাকা। ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ জানান, ইজিবাইক অটোভ্যান ছিনতাইয়ের মূল লক্ষ হলো ব্যাটারি।
৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দাম হওয়ায় ছিনতাইকারীদের লক্ষ্য থাকে ব্যাটারির দিকে। পুরাতন এসব ব্যাটারি বিক্রি করার চক্র রয়েছে ছিনতাইকারীদের। যশোর অটোভ্যান, রিকসা ও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহিন হোসেন বলেন, প্রায়ই ইজিবাইক ছিনতাইয়ের খবর শুনি। অনেকেই চালককে ছেড়ে দেয়, আবার অনেককে ছিনতাই শেষে হত্যাও করে। রেজিস্ট্রেশন না থাকায় দ্রুত রঙ পরিবর্তন করে অন্য কোথাও বিক্রি করা যায় বলে ইজিবাইকের দিকে ঝোঁক ছিনতাইকারীদের। আবার ব্যাটারির দামও বেশি বলে ছিনতাই করা লাভজনক বলে জানান তিনি।’
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবুল বাশার বলেন, ‘ভ্যান, রিকসা বা ইজিবাইকের পার্টসের ভিতরে ব্যাটারির দাম বেশি। ফলে ছিনতাইকারীদের টার্গেট থাকে ব্যাটারির দিকে। আর ছিনতাইয়ের পরে ব্যাটারি আলাদা করে বিক্রি করে দেয়। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেয়ে এসব অপরাধ করে। সেখানে কোন চালক যদি ছিনতাইকারীদের চিনতে পারে বা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে তাহলেই ছিনতাইকারিরা বাঁচার জন্য ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করে। এতে অনেকেই আহত কিংবা নিহত হয়। এসব ঘটনায় মামলার পরে পুলিশ জড়িতদের আটক বা রহস্য উদঘাটন করেছে। তবে চালকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।’