বাংলার ভোর প্রতিবেদক
জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, শাহীন চাকলাদার ৩৮ লাখ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন। দুদকের তদন্তে সেটি প্রমাণিতও হয়। এরপর দলের শীর্ষ ক্ষমতায় থেকে শাহীন চাকলাদার তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান, পরবর্তীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা শাহীন দীর্ঘ ক্ষমতার আবর্তে হয়ে ওঠেন জেলার একক নিয়ন্ত্রক। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার কারণেই দৃশ্যত দুর্নীতির সেই মামলার রায় হয়নি। অবশেষে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি সেই মামলায় চার বছরের কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের রায় দেন যশোরের আদালত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান শাহীন। তার বিরুদ্ধে সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) উপাচার্য ছিলেন প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার। টানা দুই মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব থাকাকালীন তিনি নিয়োগ বাণিজ্য স্বজনপ্রতি, নিয়োগ বাণিজ্য, ইউজিসি অনুমোদন বহির্ভুত পদে নিয়োগে দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিণত করেছিলেন। অবৈধভাবে নিয়োগ এবং সরকারি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক যশোরের তৎকালীন উপ-পরিচালক আল-আমিন। মামলার তদন্ত শেষে সম্প্রতি সাত্তারসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। বর্তমানে তিনি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুটি দুদকের মামলা বিচারাধীন।
শাহীন চাকলাদার কিংবা সাবেক ভিসি সাত্তার নয়; গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে নড়েচড়ে বসেছে যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের কর্মকর্তারা। দুদকের জালে আটকে গেছেন যশোর নড়াইলের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্তকর্তারা। নজরদারিতে রয়েছেন অর্ধশতাধিক সরকারি আমলা ও সাবেক জনপ্রতিনিধি। ধরপাকড়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধে যেমন রেকর্ড সাফল্য দেখিয়েছে, তেমনি মামলা-চার্জশিটেও অপেক্ষাকৃত বেশি আসামিকে অভিযুক্ত করেছে সংস্থাটি। অন্তর্বর্তী সরকারের আগের সময়কালের সঙ্গে তুলনা করলে গত ১৬ মাসে মামলা ও চার্জশিট যেমন বেড়েছে; তেমনি দুদকের জালে ফেঁসেছেন অনেক রাজনৈতিক ও সরকারি বড় বড় আমলা। মামলার আসামিদের তালিকায় রাজনীতিকদের চেয়ে বেশিরভাগ সরকারি আমলা। তবে অধিকাংশই বিচারাধীন।
যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এনফোর্সমেন্ট ছিলো ১৬টি। অনুসন্ধান করেছে ৩৮টি। এরপর মামলা হয়েছে ২২টি। চার্জশিট দেয়া হয়েছে ১৪টি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুদক সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান চালিয়েছে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, কাস্টসম, বিআরটিএ, জেলা ও উপজেলায় সরকারি হাসপাতাল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী, ভূমি অফিস, পৌরসভা, জেলা পরিষদসহ সরকারি দপ্তরগুলোতে। প্রায় প্রতিটি দপ্তরেই নানা অসংগতি দেখেছে। কয়েকটি জায়গায় মামলা হলেও বাাকগুলো তদন্তাধীন বলে জানা গেছে। আদালতের মাধ্যমে দুদক ইতোমধ্যে ছয় সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং তাদের স্ত্রীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
এর মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার, সাবেক এমপি রনজিৎ রায়, সাবেক পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল। এছাড়া আরও তিনজনের জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। সর্বশেষ, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র হায়দার গনি খান পলাশ, যশোর-২-এর সাবেক সংসদ মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরে সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একের পর এক ছাড় পেয়ে গেলেও বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা তদন্তে খুবই কঠোর অবস্থানে ছিল দুদক। অনেক ঘটনায় দৃশ্যমান প্রমাণ থাকলেও দুদকের কর্মকর্তারা এর কোনো প্রমাণ পাননি। নির্বাচন কমিশনে নিজেদের দেয়া হলফনামায় আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ থাকলেও ভুল হয়েছে অজুহাত গ্রহণ করে অনেককে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
এই বিষয়ে টিআইবি যশোরের সভাপতি পাভেল চৌধুরি বলেন, ‘বিগত সময়গুলোতে দুদক ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি এমন ঘটনা অহরহ। সংস্থাটি বিগত সরকারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন অনেকটা স্বাধীন হয়েছে বলেই বিগত সরকারের আমলা জনপ্রতিনিধিরা তাদের জালে আটকে যাচ্ছে। যদিও দুদক ও বিচার ব্যবস্থা সংস্কার হওয়া জরুরি। তা না হলে যারাই ক্ষমতায় থাকবে; তাদের বিরুদ্ধে এ সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না।’
যেসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে : জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নড়াইলের সাবেক এমপি কবিরুল হক মুক্তি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সঞ্চয় ব্যাংকের ১৭ গ্রাহকের পাশবই ব্যবহার করে সরকারি ১ কোটি ৭৮ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাতের মামলায় যশোরের সাবেক পোস্টমাস্টার মো. আব্দুল বাকিসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে দুদক চার্জশিট দিয়েছে। যশোর শিক্ষাবোর্ডে ৭ কোটি টাকার চেক জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়ায় বোর্ডের হিসাব সহকারী আব্দুস সালামসহ দুদক ১১জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। এছাড়া চলতি বছরের৭ অক্টোবর যশোরের বেনাপোল কাস্টমস হাউসে ঘুষের নগদ টাকাসহ রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তার ও সহযোগী হাসিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক যশোরের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, ‘দুদক বিগত সময়কালের চেয়ে এখন অনেক বেশি স্বাধীন। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করছে দুদক। অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করেছি। তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন সময় অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্নজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’
