♦ ৩ হাজার গাছ কাটছে জিলা পরিষদ ও বনবিভাগ
♦ ফুঁসে উঠেছেন সচেতন নাগরিক সমাজ
♦ ১২ কোটি টাকার গাছ কাটলেও রোপণ করেনি একটিও
বাংলার ভোর প্রতিবেদক
প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে যশোর। এপ্রিলের শুরু থেকেই এই অবস্থা। শুক্রবার এ জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বনায়ন ও সড়কগুলোতে ৩ হাজার গাছ কাটতে একাট্টা যশোর জেলা পরিষদ ও বন বিভাগ। এর আগে গত ছয় বছরে মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য জিলা পরিষদের মালিকানাধীন সাড়ে তিন হাজার গাছ কেটেছে জেলা পরিষদ। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। তবে বিপুল পরিমাণ গাছ নিধন করা হলেও এই সময় একটিও গাছ রোপণ করেনি জিলা পরিষদ।
এদিকে বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে পরিবেশবাদীসহ সচেতনমহল। তাদের দাবি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশের জন্য এই বিশাল সংখ্যক গাছের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবাদ জানিয়ে উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য বন বিভাগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটি।
সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল অপ্রচলতি দুটি পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২ হাজার ৪৪টি বড় গাছ কাটার দরপত্র আহ্বান করে যশোর সামাজিক বন বিভাগ। দরপত্র বিজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম। দরপত্রে উল্লেখিত এসব গাছের মধ্যে রেইনট্রি, বকাইন, মেহগনি, সেগুন, বাবলা, খৈয়েবাবলাসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সামাজিক বনায়নের আবর্তকাল উত্তীর্ণ বাগান ও অন্যান্য উৎসের বনজ দ্রব্য বিক্রির লক্ষ্যে নির্ধারিত শর্তানুসারে দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর থেকে আন্দুলিয়া পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার সড়কের ২৪৩টি, চাঁচড়া-ভাতুড়িয়া-সাড়াপোল হয়ে তেঁতুলিয়া গ্রাম পর্যন্ত ৯ কিলোমিটারে ৯৭৯টি, কেশবপুর উপজেলার বড়েঙ্গা বাজার থেকে পাচারই বাজার পর্যন্ত ৪ কিলোমিটারে ৫০২টি ও বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাকোলা বাজার থেকে তালবাড়িয়া পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের ৩১০টি বর্ষীয়ান গাছ বিক্রি করা হবে। এসব গাছের মধ্যে রেইনট্রি, বকাইন, মেহগনি, সেগুন, বাবলা, খৈয়েবাবলাসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ রয়েছে। এসব গাছে অসংখ্য পাখির বাসা রয়েছে। বন বিভাগের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহবান জানিয়েছে যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটি।
কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আজিজুল হক ও সদস্যসচিব জিল্লুর রহমান ভিটু গণমাধ্যমের কাছে এক বিবৃতি পাঠিয়েছেন।
ওই বিবৃতিতে তারা বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের গাছ সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর হতে আন্দুলিয়া পর্যন্ত ২৪৩টি বর্ষীয়ান বৃক্ষ, চাঁচড়া থেকে ভাতুড়িয়া, সাড়াপোল, তেতুলিয়া পর্যন্ত ৯৭৯টি বর্ষীয়ান বৃক্ষ, কেশবপুর উপজেলার বড়েঙ্গা বাজার থেকে পাচারই পর্যন্ত ৫০২টা, বাঘারপাড়া উপজেলার দোহাখোলা থেকে তালবাড়ীয়া পর্যন্ত ৩১০টি বৃক্ষ বিক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করেছে। বিবৃতিতে আরও বলেন, আমরা বন বিভাগের এই অপরিণামদর্শী উদ্যোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অবিলম্বে বন বিভাগের দরপত্র আহ্বান বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে পরিবেশ বিধ্বংসী, গাছ বিধ্বংসীদের বিরুদ্ধে সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
সঙ্গে শহরের বেজপাড়া এলাকার কবরস্থানের গাছ নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। যশোরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম বলেন, আমার যা বলার তা লিখিতভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলে দিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।
সম্প্রতি যশোর শহরের বেজপাড়া কবরস্থানের ৫০টি গাছ বিক্রি নিয়ে প্রতিবাদ জানায় সচেতন যশোরবাসী। অভিযোগ ছিল, কবরস্থান কমিটির সদস্যরা কোনো সরকারি দপ্তরের অনুমতি না নিয়েই ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় ৫০টি ছোট বড় গাছ বিক্রি করে দেয়। যশোরে অতিতীব্র দাবদাহের মধ্যে উঠে এসেছে যশোর জেলা পরিষদের বিগত কয়েক বছরে ৪ হাজারের বেশি গাছ কাটার বিষয়। এ সময়ের মধ্যে তারা নতুন কোনো গাছ লাগায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছে কয় লেন রাস্তা হবে সেটা চূড়ান্ত না হওয়ায় ইচ্ছামতো তারা গাছ লাগাতে পারছেন না। এমনকি তাদের গাছ লাগানোর কোনো নির্দেশনাও নেই।
এদিকে, যশোর-নড়াইল মহাসড়কের ৯৬১টি গাছ কাটার কার্যাদেশ দিয়েছে জিলা পরিষদ। সড়কের দুই ধারের গাছ কাটা চলমান রয়েছে। এই গাছসহ গত ছয় বছরে চারটি সড়কের পাশ থেকে তাদের মালিকানাধীন ১৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ২১০টি গাছ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৮৯৫টি গাছ কাটা হয়েছে যশোর-খুলনা মহাসড়ক উন্নয়নের সময়। যার বিক্রয় মূল্য ছিল চার কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০২১ সালে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের হৈবতপুর ব্রিজ এলাকা থেকে ৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা মূল্যের ১২টি গাছ কাটা হয়। ওই বছর যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কে ৮৩৫টি গাছ কাটা হয়। যার মূল্য দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২২ সালে যশোরের রাজারহাট থেকে চুকনগর মহাসড়কে ৫০৭টি গাছ কাটা হয়। যার মূল্য ছিল এক কোটি ৫৭ লাখ টাকা। বর্তমানে যশোর-নড়াইল সড়কে চার কোটি ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৯৬১টি গাছ কাটা চলমান। এ ছাড়া ঐতিহাসিক যশোর রোডের (যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের) শতবর্ষী রেইনট্রি গাছসহ অন্যান্য গাছ বিক্রির উদ্দেশ্য তালিকাভুক্ত করেছে ৬৯৭টি। তবে ঐতিহাসিক যশোর রোডের এই শতবর্ষী গাছ না কাটার জন্য পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আপাতত গাছ কাটছে না জেলা পরিষদ।
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. ছোলজার রহমান। তিনি বলেন, ‘পরিবেশের প্রতি অতীত ও বর্তমানের দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক আচরণের পাশাপাশি আরও কয়েকটি কারণ এ অঞ্চলের উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। প্রথম, গত এক দশকের মধ্যে এ অঞ্চলের অনেক সড়ক মহাসড়কের দুই পাশের বৃক্ষ উজাড় করা হয়েছে। এর মধ্যে যশোর খুলনা, যশোর ঝিনাইদহ, যশোর বেনাপোল, যশোর চৌগাছা-মহেশপুর, যশোর- চুকনগর সড়ক অন্যতম। জমির হিসেবে সড়কের পাশ থেকে প্রায় আটশ’ হেক্টর গাছ উজাড় করা হয়েছে। অল্প সময়ে একযোগে এই পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা বড় একটি কারণ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাতে আমাদের অতিজরুরি বেশি বেশি বৃক্ষরোপণের উপর জোর দিতে হবে।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে যশোর রোড উন্নয়ন ও শতবর্ষী গাছ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, ‘সড়ক উন্নয়ন হবে সেটা তো ভালো কথা। গাছ রেখেও পার্শ্ববর্তী দেশে উন্নয়ন চলছে। কিন্তু গাছ কাটতে পারলে তো টাকা খাওয়া যাবে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল দায়িত্ব নেয়ার পর অপরিকল্পিতভাবে গাছ সাবাড় করেছেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই গাছ কেটেই গেছেন। কখনো একটি গাছও লাগায়নি। যশোরাঞ্চলের মহাসড়কের দু’ধারের সব গাছ তিনি খেয়ে মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছেন। এর প্রভাবে কয়েকবছর ধরে এই অঞ্চলে আবহাওয়া বিরুপ আচরণ করছে।’
এ বিষয়ে যশোর জিলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান বলেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ মহাসড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জিলা পরিষদকে গাছ অপসারণের চিঠি দেয়। সেই চিঠির আলোকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির অনুমোদন ও বিভাগীয় কমিশনারের অনুমোদন সাপেক্ষে গাছ কাটার টেন্ডার করা হয়। গাছ বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে।
এই বিষয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল বলেন, ‘গাছ লাগানোর জন্য আমাদের কোন নির্দেশনা ছিলো না। সড়কগুলো কয় লেন হবে সেটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি; ইচ্ছামতো জায়গায় গাছ লাগালে তো আর হবে না। আমরা এবার সড়ক ও জনপদ বিভাগে রাস্তার শেষ সীমানা বের করে দেয়ার চিঠি দিবো। বিগত সময়ের গাছ বিক্রির টাকার ফান্ড আছে ব্যাংকে। নির্দেশনা পেলে আমরা গাছ লাগাবো।’