বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর শহরের চিত্রা মোড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা বিশিষ্ট একটি ভবন। পাঁচ তারকা হোটেলটি একদিন আগেও ভবনটির গ্লাস আর অ্যালুমিনিয়ামের পাতের বহিরাবরক চকচক করছিলো। অথচ আজ সেই ভবনটির অবকাঠামো ছাড়া আর কিছু নেই। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পর লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেলের ভিতরে পুড়ে যাওয়া বালিশ কাঁথা বিছানা চাদর থেকে শুরু করে বিলাসবহুল সব জিনিসপত্র। এমনকি মঙ্গলবার দিনভরও লুটপাট করতে দেখা গেছে। যে যেভাবে পারছেন জিনিসপত্র ভেঙ্গে খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালের মালিক যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। তিনি যশোর -৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পাওয়ার পর সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে যশোর শহরে মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। ওই মিছিল থেকে বিক্ষুব্ধ লোকজন চিত্রা মোড়ে অবস্থিত হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর শুরু করে। দ্বিতীয় দফায় বিকেল চারটার দিকে লোকজন সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার দিকে পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ওই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এঁদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার এক নাগরিকও আছেন। আহত হয়েছেন ২৩ জন। হোটেলে তৃতীয় তলার মদের বার থেকে কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। লুটপাটের সময় সেখানে আটকা পড়ে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।
যশোর জেনারেল হাসপাতাল ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহতের বেশির ভাগ আন্দোনলকারীরা। ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগের সময় অনেকেই কৌতুহলবশে হয়ে অগ্নিসংযোগকারীেদের সঙ্গে হোটেলে প্রবেশ করেন। প্রায় দুই শতাধিক আন্দোলনকারীরা হোটেলটির বেজমেন্টে ঢুকেই সিঁড়ি বেয়ে ১৪ তলা পর্যন্ত উঠে যায়। এক পর্যায়ে নিচে থাকা বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন যুবক পেট্রল দিয়ে আগুন দিতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তারা কয়েকটি তলাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে দাউ দাউ করে পুরো ১৪ তলায় কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্বলতে থাকে। এতে উপরে থাকা বেশির ভাগ আন্দোলনকারীরা বের হতে পারেনি। ফলে আগুনের ধোয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আটকে থেকে তারা মারা গেছে। তবে কতজন আন্দোলনকারী, বা হোটেলটির অতিথি, কর্মকর্তা, কর্মচারী মারা গেছে সেটা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি। যার কারণ হিসাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালে মরদেহ আসলেই স্বজনেরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে গেছে। পুলিশ প্রশাসন মাঠে না থাকাতে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশে নিহতের নাম ঠিকানা তালিকা করেই মরদেহ হস্তান্তর করেছেন। আর আহতদের খুলনা ও ঢাকাতে রেফার্ড করা হয়েছে।
যশোর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ পরিচালক দেওয়ান সোহেল রানা বলেন, ‘জাবির হোটেলে আগুন লাগার খবর পায় সোমবার বেলা ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে। এর পর গাড়ি নিয়ে বের হতে গেলে দেখি আমাদের গেটের সামনে আন্দোলনকারীরা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের বের হতে দিবে না। এর কিছুক্ষণ পরেই আবার তারাই আমাদের বলে দ্রুত চলেন হোটেলের ভিতরে আমাদের লোকজন আটকে গেছে। তাদের বাঁচাতে হবে। হোটেলের কাছে যেয়ে দেখি পুরো হোটেলটি জ্বলছে। পরে জেলার আরোও পাঁচটি স্টেশন ও খুলনার একটি স্টেশন দিয়ে ৭ ঘন্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। এই ঘটনায় হোটেল থেকে আমরা ২৪টি মরদেহ উদ্ধার করেছি। দুইজনকে হেলিকপ্টার দিয়ে আহত অবস্থায় উদ্ধার করি।
তিনি বলেন, কি দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেটা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। হোটেলে নিজস্ব অটোমেটিক অগ্নিনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থাকলেও আগুন লেগে অকেজো হওয়াতে সেগুলো কাজ করেনি। এছাড়া হোটেলে বেশি ডেকারেশন করাতে আগুন বেশি ছড়িয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।’
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘জাবির হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেশির ভাগকেই মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে। মৃতদের মরদেহ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৩ জন। তাদের বেশিরভাগের শরীরের ৩০ভাগ পুড়ে যাওয়াতে খুলনা ও ঢাকাতে রেফার্ড করা হয়েছে। নিহত বিদেশি নাগরিকের বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ার এম্বাসি থেকে খোঁজখবর নেয়া হয়েছে।’
এদিকে, আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর থেকে হোটেলকে ঘিরে ছিল সাধারণ মানুষের কৌতূহল। বিভিন্ন জায়গা থেকে শত শত মানুষ হোটেলটি দেখতে আসছিলেন। মঙ্গলবার বেলা ১২ টার দিকে গিয়েও দেখা গেছে সেই চিত্র। কেউ আগুনে পোড়া ধ্বংস হওয়া বাড়ির ছবি তুলছেন, কেউ আবার সেলফি তুলছেন। মোবাইলে ভিডিও করে রাখছেন অনেকেই। শহরের বিভিন্ন বস্তি ও রিকসা ইজিবাইক চালকেরা ও তাদের পরিবারের স্বজনেরা দল বেঁধে এসেছে। তারা হোটেলের ভিতরে থাকা পোড়া অর্ধপোড়া আসবাবপত্র থেকে শুরু করে টেলিভিশন, কম্পিউটার, ফ্রিজ এসি থেকে শুরু করে বিলাসবহুল জিনিসপত্র খুলে খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। ভ্যান রিকসা ইজিবাইক করে যে যা পারছেন তাই নিয়ে যাচ্ছেন।
তালতলা বস্তি থেকে আসা নুর নাহার বলেন, ‘জনগণের টাকা মেরে চাকলাদার এই হোটেল বানিয়েছে। এখন এই জিনিস আমাগের। যে যা, যেভাবে পারছেন সেভাবে লোকজন নিয়ে যাচ্ছেন। কিছু রাখছে না ভিতরে। পুড়া হোটেলে শত শত মানুষ।’ ছবিরন নামে আরেক মহিলা বলেন, ‘ভোরে শুনি চাকলাদারের হোটেলে মানুষ যা পারছে, তাই নিচ্ছে। তাই আমিও এসেছি। মৃদু হেসে এই নারী বলেন, পুড়া খাট খুলে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বড় বড় জিনিসপত্র মানুষ এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে। গরিবের টাকা হক মেরে বড় লোক হয়েছে। তাই এগুলো আমাদের হক।’
শফিকুল জুয়েল নামে ওষুধ কোম্পানির এক প্রতিনিধি পোড়া জাবির হোটেলের ও লুট হওয়ার ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করছিলেন। তাকে বলতে শোনা যায়- চাকুরির সুবাধে যশোরে এক যুগ ধরে বসাবস। মফস্বল শহরে পাঁচ তারকা হোটেল। তাও করেছে আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। শুনেছি মাঝে মধ্য শাহীন চাকলাদার হোটেলে বষে রাজনীতি, প্রশাসন, সবই চালাতো। আজ তার কোনো অস্তিত্বই নেই। বেশি অহংকার কোনো দিনও ভালো কিছু বয়ে আনে না, এটা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
শাহীন চাকলাদারের হোটেল ছাড়াও শহরের কাজীপাড়া কাঠালতলাস্থ তার বাসভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া তার চাচাতো ভাই জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টুর বাসভবন, সদরের মালঞ্চিতে চাঁদ ফুড ও ডিমের কারখানাতে লুট করেছে দুর্বৃত্তরা।
শহরের চারখাম্বা মোড়ে অবস্থিত শেখ রাসেলের ভাস্কর্যও ভাঙচুর করা হয়েছে। এছাড়া চাঁচড়া মোড়ে যশোর-১ আসনের সংসদ শেখ আফিল উদ্দিনের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। জেলার আট উপজেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতেও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সোমবার বিকেল থেকে মঙ্গলবার বেলা একটা পর্যন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতালে ৪৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন বলে হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানিয়েছেন। সার্বিক বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কেউ কল ধরেননি।