বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর জেলার ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদের এক হাজার ৩২৩ জনপ্রতিনিধির অধিকাংশই পলাতক রয়েছেন। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে ভেঙে পড়েছে কার্যক্রম। সেবা নিতে আসা মানুষ পড়ছেন বিপাকে। তবে সরকার ইতোমধ্যে নির্দেশনা জারি করেছে, জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা গতিশীল করবেন কার্যক্রম।
জানা যায়, যশোরে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভায় এই চার স্তরে ১ হাজার ৩২৩ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে ৯১টি ইউনিয়নে ৯১জন চেয়ারম্যানসহ ১ হাজার ১৮৩ জন, ৮টি উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান ও ২জন করে ভাইস চেয়ারম্যান মিলে ২৪জন, ৮টি পৌরসভায় ১০৪ জন এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ ১২জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এক দিন পর রাষ্ট্রপতি সংসদীয় ক্ষমতাবলে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হলেও বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরগুলো কাগজে কলমে কার্যকর থাকলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদের সকল সদস্য লাপাত্তার খবরে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরাও গা ঢাকা দেন। এতে স্থানীয় সরকারের এসকল দপ্তরের সেবা কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত নির্বাচনী খেলার মাধ্যমে যারা জনপ্রতিনিধির তকমা গায়ে জড়িয়ে চেয়ারে বসেছিলেন তাদের অধিকাংশ সমাজের খারাপ লোক হিসেবে পরিচিত। এসব জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই বিভিন্ন হত্যাকান্ড, লুটপাট, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, হুন্ডি ও স্বর্ণের পাচার, নারী ও শিশু পাচার, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা রকম সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
যার কারনে এরা দিনে দিনে জনশত্রুতে পরিণত হন। এদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় দানব হিসেবে জনগণের কাছে চিহ্নিত ছিলেন। তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পর্যন্ত সাহস পাননি। চুন থেকে পান খসলেই এসব নামধারী জনপ্রতিনিধি ও তাদের ক্যডারদের হাতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু মানুষ।
এমনকি সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরাও এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহায় পাননি। এসব ঘটনার প্রতিবাদে কেউ আইনের আশ্রয় নিতেও সাহস দেখাননি। পুলিশী ভূমিকা ছিল দলীয় ক্যাডারদের মতোই। কেউ পুলিশের কাছে কোন নালিশ বা অভিযোগ দায়ের করার সাথে সাথে সেই তথ্য অভিযুক্তকে জানিয়ে দিতো পুলিশের সদস্যরা। ফলে অভিযোগকারীকে ফের হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হতো।
জুলাই গণবিপ্লব এবং ৫ আগষ্ট মহাবিপ্লবের পর সরকারের পতন ঘটলে নামধারী এসব জনবিছিন্ন জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রাণ ও জানমাল রক্ষায় গা ঢাকা দেয়। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধির তমকা গায়ে জড়িয়ে যারা বিগত দিনে সরকারী দলের ছত্রছায়ায় কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তারা এলাকা ছেড়ে দেন।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান যুবলীগ নেতা তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু, যশোর পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধার হায়দার গণি খান পলাশ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা সাইফুজ্জামান পিুকল, চৌগাছা পৌর মেয়র নূর উদ্দিন আল মামুন হিমেল, ঝিকরগাছা পৌরসভার মেয়র মোস্তফা জামাল পাশা, উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম মনির, মণিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু, পৌর মেয়র মাহামুদুল হকসহ জেলার সকল উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বররা এলাকা ছাড়া হয়েছেন।
যশোর সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন, নওয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির তুহিন, লেবুতলার চেয়ারম্যান আলিমুজ্জামান মিলন, উপশহরের চেয়ারম্যান এহসানুর রহমান লিটু, চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দাউদ হোসেন, আরবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহারুল ইসলাম, দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান আনিচ, নরেন্দ্রপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাজু আহমেদসহ অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বররা পালিয়ে গেছেন। ফলে দীর্ঘ দিন এসব জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারগুলো অরিক্ষত হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান বলেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে অদ্যাবধি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বরগণ কেউ অফিসে আসেননি। ফলে কাজ কর্মে কিছুটা গতি হারিয়েছে।
যশোর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন বিশ্বাস বলেন, চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যানরা কেউ অফিস করছেন না। ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটছে।
অপরদিকে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং রাজপথের বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অবিলম্বে ভোটার বিহীন স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন বাতিল করে দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করতে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
এই বিষয়ে যশোরে স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক রফিকুল হাসান বলেন, বর্তমান সরকার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত। বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় সরকারের কাজকর্মে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এখন এই বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসনে আমরা যারা দায়িত্বে আছি তারা কাজ করবো।