বাংলার ভোর প্রতিবেদক
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে অনিয়ম দুর্নীতি চলছে লাগামহীনভাবে। আর এই অনিয়ম দুর্নীতি শুরু পিসি বই থেকে। টাকা দিলে জেলখানায় চাহিদা অনুযায়ি সব কিছুই মেলে। অর্থবিত্তশালীরা বাড়ির মতোই জেলখানাতেও বসবাস করে আরাম আয়েশে।
আর এ সব কিছুই হয় জেলার শরিফুল আলমের ইঙ্গিতে। তবে কারাগারের বাইরে এসব ঘটনার কথা কেউ প্রকাশ করেন না। কারণ বেশির ভাগ হাজতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বা অপরাধী হওয়ায় তাদের বারবার যেতে হয় কারাগারে।
কারা সূত্রে জানা যায়, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন নতুন হাজতি জেলখানায় ঢুকলে কারাকর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে পিসি বইয়ে নাম লেখাতে হয়। এভাবেই জেল খানায় টাকা আদায় শুরু হয়। যা চলে জামিনে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত। তবে জেলখানার বিভিন্ন খাতে এসব টাকা আদায়ের কাজ করে থাকে আসামি, জেলপুলিশ, ক্যান্টিনে কর্মরতরা।
সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন যশোরের বাঘারপাড়ার নাশকতা মামলার আসামি আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, কারাকর্তৃপক্ষ কারাগারে প্রবেশের আগে হাজতিকে নাম ঠিকানা লেখতে হয়। হাজতিরা তাদের নাম ও পরিচয় সঠিক দিলেও কারাকর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করে ভুল লেখে। একজন হাজতির নাম যদি হয় ‘আব্দুর রহমান’ কারাকর্তৃপক্ষ তার নাম লিখবে ‘আব্দুর বহমান’। আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও ‘র’ ও ‘ব’ এর বেড়াজালে আটকে দেয়া হয় ওই হাজতিকে।
গেটের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীকে টাকা দিলে ‘ব’ আবার ‘র’ হয়ে যায়। টাকা দিতে না পারলে থাকে অতিরিক্ত একদিন হাজত খাটতে হয়। তবে এ টাকা হাজতিকে দিতে হয় পিসি বইয়ের মাধ্যমে।’
তিনি আরও বলেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পিসি বইয়ের দায়িত্বে রয়েছেন শাহনেওয়াজ। শাহনেওয়াজ সেনাবাহিতে কর্মরত অবস্থায় অপরাধে দায়ে কারণে ১০ বছরে জেল হয়েছে। হাজতিদের স্বজনরা এসে পিসি বইতে টাকা জমা দেয়। কিন্তু শাহনেওয়াজ পিসিতে টাকা জমা না দিয়ে আমার মতো অনেক হাজতির টাকা আত্মসাৎ করে। আমার বড় ভাই পিসি বইতে ১৫শ’ টাকা জমা দেন। কিন্তু শাহনেওয়াজ সেই টাকা আত্মসাৎ করে।
হত্যা মামলায় ভোলার চরফ্যাশনে একজন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে। এ আসামির মা আয়েশা বেগম বলেন, কারাগারে প্রবেশের প্রথম দিন আমদানিতে রাখা হয় ছেলেকে। পিসি বইয়ের মাধ্যমে আমদানিতে বেড পেতে ৫শ’ টাকা দিতে হয়েছে। পরের দিন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানেও টাকা গুনতে হয়েছে তাকে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলেও টাকা দিতে হয়। কয়েক দিন আগে ছেলে অসুস্থ ছিল। কারাগারের মেডিকেলে সিট পেতে টাকা দিতে হয়েছে। আমার ছেলের ভর্তির দিন ৬৫ সিটের বিপরীতে রোগী ছিল ৪০/৪৫ জনের মতো। কিন্তু ছিট পেতে পিসি বইতে ৩শ’ টাকা দিতে হয়েছে। তারপর ছিট পায় ছেলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারা কর্মকর্তা বলেন, কারাগারের অভ্যন্তরে ফেনসিডিল, ইয়াবা ট্যাবলেট, গাঁজা বিক্রি হয়। যেহেতু কারাগারে বেশির ভাগ মাদক বিক্রির অপরাধিকে পাঠানো হয়। তারা বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কারাগারে মাদক নিয়ে আসে ও বিক্রি করে। প্রায় প্রতিদিন এক-দুইজন করে ধরাও পড়ে। এছাড়াও দায়িত্বরত আমাদের অনেক লোক অর্থের বিনিময়ে মুঠোফোন ব্যবহারে সাহায্য করে।
তিনি আরও বলেন, অনেক হাজতি কারাগারে আসার সময় শরীরে বিশেষ কায়দায় ইয়াবা বা গাঁজা নিয়ে আসে। তাদের বিশেষভাবে শরীর চেক করার পর ধরা পড়ে। আবার অনেকে হাজতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব মাদক কারা অভ্যান্তরে আনে। কারাকর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে সহযোগিতা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সব কারণে কারা অভ্যান্তরে মাদকের কারবার বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক কারা অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া কারা সীমানার ভিতরে মুদি দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। হাজতিদের কোন খাবারের প্রয়োজন হলে ওই দোকান থেকে বাধ্যতা মূলক কিনতে হবে। বাইরে থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনে আনলে তা কারা অভ্যন্তরে হাজতিদের দেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রেও কারা কর্তৃপক্ষ মোটা অংকের টাকা ব্যবসা করছে। ওই মুদি দোকান থেকে খাদ্য দ্রব্য অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে কিনতে হাজতিদের স্বজনদের বাধ্য করা হচ্ছে। তিনজন জামিন প্রাপ্ত আসামি বলেন, কারাগারে ভাতে পোকা, ঘাস-পাতা পাওয়া যায়। একই সাথে ২৫ গ্রাম ওজনের মাস-মাংস দেয়।
কারাগারে খাবার খুবই নিম্নমানের। বন্দিদের উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও কারা কর্তৃপক্ষ সেটা করে না। তবে টাকার বিনিময়ে ক্যান্টিন থেকে চড়া মূল্যে মাছ ও মাংস কিনে খেতে পারেন বন্দিরা। তাই যাদের সামর্থ আছে তারাই কারাগারে বসে ভালমন্দ কিনে খেতে পারে।
তারা আরও বলেন, কারাগারের ভিতরে নগদ টাকা বহন করা বড় ধরনের অপরাধ। তাই বাইরে থেকে কেউ টাকা দিতে চাইলে ব্যাংক হিসেবের মতো পিসি বইতে জমা করতে হয়। কারো টাকার প্রয়োজন হলে পিসি বইয়ের মাধ্যমে ক্যান্টিন থেকে লেনদেন করে। আর এখানেই হলো আসল দুর্নীতি। কেউ একশ’ টাকা চাইলে তাকে দেওয়া হয় ৯০ টাকা। বাকি ১০টা কমিশন বাবদ কেটে রাখা হয়।
এ বিষয়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলার শরিফুল আলমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, এ সব তথ্য কোথা থেকে পেলেন ? আপনি এসে দেখে যান। বললে অনেক কিছুই বলা যায়। তবে পিসি বই ও দোকান থেকে বাধ্যতামূলক পণ্য কেনার বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।