♦ শাহীন-নাবিলকে ঠেকাতে উপগ্রুপ সোচ্চার
♦ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে বিপাকে তৃণমূল
হাসান আদিত্য
যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের আধিপত্যের লড়াই শুরু হয়েছে। দুই গ্রুপের একক প্রার্থী নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার চেয়ারম্যান পদে তার চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুকে বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাকে ছাড় দিতে নারাজ যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তিনিও একক প্রার্থীর প্যানেল ঘোষণা করেছেন। তার ট্রাম্পকার্ড হিসেবে মাঠে রয়েছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল। দুই বলয়ের একক প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে অভ্যন্তরীণ ‘বিদ্রোহ’ দেখা দিয়েছে। তাই শীর্ষ দুই নেতার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দুই বলয়ের আরও ৫জন চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আধিপত্যের লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটি দেখার অপেক্ষায় যশোরবাসী।
যশোর সদর উপজেলার রাজনীতি দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও অপরটি স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন আগে নাবিল আহমেদের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতেন। তবে তাদের সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় বর্তমানে তিনি শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে রাজনীতি করছেন। দলীয় কার্যক্রমে একসঙ্গে অংশ নিচ্ছেন। এসব কার্যক্রমে কাজী নাবিলকে দেখা যায় না। তিনি আলাদাভাবে দলীয় কার্যক্রম করেন। শাহীন ও নাবিলের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নকে ঘিরে। সদর আসনে দু’জনেই দলীয় মনোনয়ন চাইলেও পেয়েছিলেন নাবিল। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন শাহীনের সমর্থকরা। এরপর আবারও ২০১৮ সালে মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন শাহীন। দল আবারও মনোনয়ন দেয় নাবিলকে। এতে শাহীন-নাবিলের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়। ২০২০ সালে কেশবপুরের সংসদ সদস্য ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন শাহীন চাকলাদার। তিনি কেশবপুরের এমপি হলে সদরে তাঁর একক আধিপত্যে ভাটা পড়তে থাকে। ফলে তাঁর দীর্ঘদিনের শীর্ষ অনুসারীরা ভেড়েন নাবিলের ডেরায়। এর পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কেশবপুরে দলীয় মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল আজিজের কাছে পরাজিত হন। রাজনীতিতে শাহীনের অস্তিত্বের স্বার্থে তিনি আবারও সদরে রাজনীতিতে ফিরতে থাকেন। আবারও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়নে তিনি সভা সমাবেশ করেছন। ফলে নাবিলের আসনে শাহীন সংক্রিয় হওয়াতে নাবিল-শাহীন এই দুই শীর্ষ নেতার দ্বন্দ্ব এখনও প্রকট হওয়ার মুখে।
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সদর থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় পুরো জেলার রাজনীতি। সদর উপজেলায় শাহীনের বেশ প্রভাব রয়েছে, রয়েছে অনেক অনুসারী। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে এই উপজেলার টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে কেশবপুরের সংসদ সদস্য হওয়ার পর সদরের রাজনীতিতে কিছুটা আলগা হয়ে যান। তাই এখন আবারও সদরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে চান জেলা আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা।
তারই প্রথম ধাপ হিসেবে উপজেলাতে বসাতে চান তারই চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। ফন্টু ছাড়াও শাহীন অনুসারীদের মধ্যে সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলাম ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জুয়েল। আর নাবিল গ্রুপের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, যুব মহিলা লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের নেতা ফাতেমা আনোয়ার এবং বর্তমান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল। তবে উপজেলা নির্বাচনে শাহীন প্যানেল ঘোষণা করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদার, ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আরা মিলি। নাবিলের প্যানেলে চেয়ারম্যান প্রার্থী বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, ভাইস চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বাশিনুর রহমান। দুই প্যানেলে দুই শীর্ষনেতারা তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে ইতোমধ্যে শহর ও বিভিন্ন ইউনিয়নে সভা সমাবেশ করছেন। ভোট চাচ্ছেন নিজ নিজ প্যানেলের প্রার্থীদের পক্ষে। এই দুই শীর্ষনেতারা একে অন্যকে সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। ভোটকে কেন্দ্র করে উপ্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নেতাকর্মীরা।
এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ‘পদবি না থাকলেও তৌহিদ চাকলাদার দীর্ঘদিন রাজনীতি করে। তৃণমূলের দাবির প্রেক্ষিতে সে প্রার্থী হয়েছে। এখানে আমার আধিপত্য কোনো বিষয় নয়। জনগণ চাইলে সে নির্বাচিত হবে, জনপ্রতিনিধিও হবে।’
আর কাজী নাবিলের মুঠোফোনে কয়েকদফা যোগাযোগ করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে তার অনুসারী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, ‘এমপি তৃণমূলের মতামতের প্রেক্ষিতে একটি প্যানেল ঘোষণা করেছে। সেই মতামতের বাইরে গিয়ে নাবিল ভাইয়ের সঙ্গে রাজনীতি করেন এমন আরো দুই প্রার্থী জনপ্রতিনিধি হওয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে প্রার্থী হয়েছে। তিনি বলেন, এতে দলে কোন্দলের সৃষ্টি হলো। কেন্দ্রীয় নেতারাই স্থানীয় রাজনীতিতে গ্রুপিংয়ের সৃষ্টি করেছে।’
দুই বলাইয়ের নেতাকর্মীরা উপগ্রুপে বিভক্ত
নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি শাহীন চাকলাদার ও এমপি কাজী নাবিল আহমেদের ‘ঘরের মধ্যে ঘর’ তৈরি হয়েছে। এই দুই শিবির থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে সাতজন প্রার্থী মাঠে রয়েছেন। এর মধ্যে শাহীন চাকলাদার গ্রুপে চারজন ও কাজী নাবিল আহমেদের গ্রুপে রয়েছেন তিনজন। ফলে দুই শিবিরে উপ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বেড়ে গেছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। তারা একে অপরকে ঘায়েল করে বক্তব্যও দিচ্ছেন। যারা দীর্ঘদিন একসাথে শাহীন নাবিলের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, নির্বাচনের সময়ে তাদের কাছে না পাওয়ায় এই শীর্ষ নেতা থেকে এড়িয়ে চলছেন দুই বলায়ের অন্য প্রার্থীরা।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহিত কুমার নাথ বলেন, ‘সদর উপজেলাতে শাহীন চাকলাদার তার ভাই ফন্টু চাকলাদারকে একক প্রার্থী চুড়ান্ত করেছে। জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতা হয়ে তিনি এমনটি করতে পারেন না। মূলত তিনি তার ভাইকে প্রার্থী করতে চান আবারও সদরের রাজনীতিতে একক আধিপত্যে বিস্তার করতে। ফাঁকিবাজী কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে তার ভাই ফন্টুকে উপজেলাতে বসাতে চাই। একক আধিপত্য আনতে পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী করছেন তিনি। এতে দলের তৃণমূলে কোন্দল সৃষ্টি হবে।’
চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে শাহীন চাকলাদার তার ভাইকে প্রার্থী ঘোষণা করছে। আমরা আশা করেছিলাম, দলের জন্য যারা দীর্ঘদিন কাজ করেছে, সেই তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাওয়ার ভিত্তিতে প্রার্থী বানাবেন। কিন্তু যার দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই এমন মানুষকে প্রার্থীতা ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাজার ছেলে রাজা হবে এই নীতিতে শাহীন চাকলাদার তার ভাইকে একক প্রার্থী করেছেন।’
নাবিল অনুসারী চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তফা ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শাহীন নাবিল দুজনেই প্রার্থীদের প্যানেল দিয়েছে। তৃণমূলে কোন্দল সৃষ্টি করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা দুজনেই প্রার্থী দিয়েছে। দলের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।’