♦ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ভুরিভোজ, আইন ভঙ্গ করা হয়েছে : শফিকুল ইসলাম জুয়েল
♦ তফসিল ঘোষণার পর কোনো প্রার্থী দলীয় সমাবেশ, খাবারের আয়োজন ও টাকা পয়সা বিতরণ করতে পারবেন না : অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন অফিসার
হাসান আদিত্য
যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে ভুরিভোজ করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার দুপুর তিনটার দিকে সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি বাজার সংলগ্ন একটি মেহগনি বাগানে এই ভুরিভোজের আয়োজন করেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না। এতে শাহীন চাকলাদারর সমর্থিত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বিপুল ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না আরা মিলিসহ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে নির্বাচনে অংশ নেয়া তিন প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন প্রধান অতিথি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর সদর উপজেলার রাজনীতি দুটি গ্রুপে বিভক্ত। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও অপরটি স্থানীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের আধিপত্যের লড়াই শুরু হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার ফন্টুকে বসাতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন শাহীন চাকলাদার। তারই অংশ হিসেবে সোমবার দুপুরে চুড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আব্দুল মান্নান মুন্না কর্মী সমাবেশের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। বিশেষ অতিথি করা হয় শাহীন সমর্থিত তিন প্রার্থীকে। এছাড়া জেলা ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ছাত্রলীগের শীর্ষনেতারা বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে শাহীন চাকলাদার তার সমর্থিত প্রার্থীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘দল অনেকদিন ক্ষমতায় যেকোন ব্যক্তি প্রার্থী হতে চাই। অনেকে প্রার্থীও হয়েছে। তবে আমরা বলতে চাই, আমরা কাউকে হত্যা করবো না, কাউকে মারবো না। আমরা জবাব দিবো, প্রতিবাদ করবো ব্যালটের মাধ্যমে। ওরা বলছে (নাবিল গ্রুপ) চুড়ামনকাটিতে নাকি মুন্নার লোক নেই। ২৯ তারিখে দেখা যাবে কাদের লোক বেশি। শেখ হাসিনা এবার সুযোগ করে দিয়েছে যাচাই বাছাইয়ের। এই সদর উপজেলাতে এই নির্বাচনই সুযোগ করে দিয়েছে কার জনপ্রিয়তা কত। এটা কিন্তু আপনাদের জন্য, আমাদের জন্য জীবনের শেষ লড়াই। নেত্রী অনেকদিন খেলার সুযোগ করে দেয়নি। এবার একটা খেলার সুযোগ পেয়েছি, এই খেলায় এবার আমাকে আপনাদের জিতাতে হবে। আমাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে হবে যেকোন মূল্যে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলে ধান কাটা চলছে। কাজ শেষ করে দুপুরে চুড়ামনকাটি বাজার সংলগ্ন স’ মিলের পিছনে একটি মেহগনি বাগানে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা দলে দলে যোগ দেন। সমাবেশে আসা লোকজনকে খাওয়ানোর জন্য বাগানে সকাল থেকে রান্নার আয়োজন চলতে থাকে। সেখানে গরু, খাসির মাংস ছাড়াও সবজি এবং ভাত রান্না করা হয়। কয়েকজন বাবুর্চি দিয়ে দুপুর পর্যন্ত রান্না চলে। সভা শেষে ওয়ার্ড ভিত্তিকভাবে সেখানে কয়েক পদের খাবার দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, ‘সভায় আসা লোকজন ও ভোটারদের খাওয়ানোর জন্য সাবেক চেয়ারম্যান মুন্না দুপুরে এ আয়োজন করেন। সেখানে এলাকার অনেকেই এসে খেয়েছেন। সেখানে এলাকার নেতা-কর্মীরা ছাড়াও বাইরে থেকে আসা অতিথি ও স্থানীয় বাসিন্দারা খেয়েছেন।’
অনুষ্ঠানের আয়োজক সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান মুন্না বলেন, ‘মূলত অনুষ্ঠানটি কর্মীসভা। আমাদের নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের প্যানেল পরিচিত সভা। এই সভায় আমাদের ফুল প্যানেল ফন্টু চাকলাদার, সুলতান মাহমুদ বিপুল, জ্যোৎস্না আরা মিলি যাতে বিজয়ী হয় সেই দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, অনুষ্ঠানে ইউনিয়নের প্রায় ১২শ’ নেতাকর্মী অংশ নেন। আলোচনা শেষে এসব নেতাকর্মীদের খাওয়ার আয়োজন ছিলো। ভাত সবজি, ডাল, মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে সদর উপজেলা পরিষদ পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শফিকুল ইসলাম জুয়েল অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটারদের আকৃষ্ট করতে আইন ভঙ্গ করে এক প্যানেলের প্রার্থীদের ভুরিভোজ করিয়েছেন। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন। দলের প্রভাবশালীর ভাই প্রার্থী হওয়ায় স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান প্রভাব বিস্তার করতে এসব করছেন। বিষয়টি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের দেখা উচিত। আমি কাল আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অভিযোগ করবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর সিনিয়র নির্বাচন কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন অফিসার আব্দুর রশিদ বলেন, নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর কোনো প্রার্থী দলীয় সমাবেশ ও খাবারের আয়োজন, এমনকি টাকা পয়সা বিতরণ করতে পারবেন না। বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিলো ২ মে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ৫ মে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১২ মে। প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ ১৩ মে। ভোট ২৯ মে। চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু ছাড়াও শাহীন অনুসারীদের মধ্যে সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহিত কুমার নাথ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জুয়েল।
আর নাবিল গ্রুপের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী, যুব মহিলা লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের নেতা ফাতেমা আনোয়ার। দুই বলয়ের একক প্রার্থী ঘোষণা নিয়ে অভ্যন্তরীণ ‘বিদ্রোহ’ দেখা দিয়েছে। তাই শীর্ষ দুই নেতার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে দুই বলয়ের আরও ৫জন চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আধিপত্যের লড়াই শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটি দেখার অপেক্ষায় যশোরবাসী।